বুধবার, ১ মার্চ, ২০১৭


পৃথিবীর ধ্বংস হওয়া নিয়ে যত মিথ

পৃথিবীর সব ধর্মেই, সব মিথেই দুনিয়া একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে বলে বর্ণিত আছে। এমন নানা বর্ণনা আছে, যেখানে বলা হয়েছে দুনিয়া প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল! আধুনিক বিজ্ঞানমতে এক সময় পৃথিবী, সূর্য সবই বিলুপ্ত হবে। সব কিছুর মত গ্রহ নক্ষত্রেরও রয়েছে জন্ম-মৃত্যু। ধর্মগ্রন্থ, মিথ ও জ্যোতিষবিদ্যার উপর ভিত্তি করে নানান সময়ে নানান লোকে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ভবিষ্যত বাণী করেছে, যার অনেকগুলোই ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। আজকের এই লেখায় সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কয়েকটির প্রতি একটু নজর দেয়া যাক-

১। পহেলা  জানুয়ারী, ১০০০ সাল

পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার এবং তৎকালীন ইউরোপের বহু ধর্মীয় পন্ডিত মত দিয়েছিলেন যে ১০০০ সালের প্রথম দিনে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যীশু খ্রিস্টের রাজত্ব টিকবে ১০০০ বছর, এইরকম একটা মিথ চালু ছিল মধ্যযুগে, সেই থেকে তাদের বিশ্বাস যে এই দিন হবে পৃথিবীর শেষ দিন। পুরোহিতদের এই ভবিষ্যত বাণীর ফলে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে এবং অসংখ্য লোক জেরুজালেমের দিকে তীর্থ যাত্রা করে।

২। পহেলা ফেব্রুয়ারী, ১৫২৪ সাল

জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহাননেস স্টফার প্রচার করেছিলেন যে, ১৫২৪ এর ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিনে বিরাট এক বন্যায় দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। বন্যায় দুনিয়া ধ্বংসের মিথ নতুন কিছু নয়- বাইবেলে নুহ এর কাহিনী, মেসোপটেমিয়ান মিথ ও ভারতীয় পূরানে মীন অবতার এর কাহিনী- সবখানেই বন্যার মাধ্যমে পৃথিবী ধংসের কাহিনী বলা হয়েছে। যাই হোক, স্টফারের ভবিষ্যৎবাণীর ফলে দেখা গেল বহু লোক উঁচুভূমির দিকে চলে গেল, একটি বিশাল নৌকাও নাকি তৈরি হয়েছিল। পরে নির্ধারিত দিনে দেখা গেল বন্যা-টন্যা কিছু না, তবে খুব ভারী বৃষ্টি হয়েছিল। জোহাননেস স্টফারকে কৃতিত্ব দেয়াই যায় সফল আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানকারী হিসেবে।

৩। ১৯১০ সাল

ধুমকেতুর লেজে থাকে বিষাক্ত গ্যাস  ‘cyanogens’। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞানীরা যখন এই তথ্য পেলেন তখন তাদের মধ্যে প্যানিক ছড়িয়ে পড়ল। কারণ কিছুদিন পর, ১৯১০ সালে হ্যালির ধূমকেতু পৃথিবীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে, তখন যদি কোনক্রমে পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ হয় তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই ১৯১০-এ হ্যালির ধূমকেতুর আগমনের দিনকে পৃথিবীর সম্ভাব্য শেষ দিন হিসেবে দেখা হয়েছিল।

৪। ৩১ আগস্ট, ২০১৩

বিখ্যাত রাশিয়ান পুরোহিত রাসপুটিন, প্রায় ১০০ বছর আগে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে ৩১ আগস্ট ২০১৩ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এক ভয়ংকর ঝড় আসবে, আগুনে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারপর সেই হিমশীতল নীরবতার মধ্যে যীশু নেমে আসবেন পৃথিবীতে এবং তার বেঁচে যাওয়া অনুসারীদের মনে সাহস দিবেন এবং শেষে ফিরে যাবেন স্বর্গে। রাসপুটিন চালাক ছিলেন, অনেক দূরের তারিখে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, যাতে এর কোন দায়িত্ব তাকে না নিতে হয়।

৫। ১৯৯৯ সাল

বিখ্যাত ভবিষ্যতবক্তা নস্ট্রাডামুস ৪০০ বছর আগে লিখেছিলেন যে ১৯৯৯ সালের সপ্তম মাসে আকাশ থেকে এক ভয়ের রাজা নেমে আসবেন, যিনি পৃথিবী ছারখার করে দিবেন। কেউ নেমে আসে নাই, তবে সেই মাসে সবচেয়ে যে বিখ্যাত যে ঘটনা ঘটে তা হচ্ছে হ্যারিপটার সিরিজের ৩য় বইটি রিলিজ হয়। তবে লোকে বলে নস্ট্রাডামুসের আরো অনেক ভবিষ্যৎবাণী নাকি সফল হয়েছিল।

৬। ১৬৬৬ সাল

৬৬৬ সংখ্যাটি শয়তানের সংখ্যা বলে অনেকে বিশ্বাস করত মধ্যযুগে। এর আগের বছর ভয়াবহ প্লেগ রোগে লন্ডনের পাঁচ ভাগের একভাগ লোক মারা যায়। কাজেই অনেকে ভাবতে শুরু করে ১৬৬৬ সালেই হয়তো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তাছাড়াও সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভয়াবহ আগুনে লন্ডনের বহু ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। কাজেই এত বিপর্যয় দেখে কেউ যদি ভাবে পৃথিবীর শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে ,তবে তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না বৈকি!

৭। ২০০০ সাল

অনেকের হয়তো মনে আছে, ২০০০ সালের আগের সেই Y2K প্যানিকের কথা। কম্পিউটার এর তারিখের সব ডিজিট যেহেতু দুই অক্ষরের তাই ২০০০ সাল এলে সব মেশিন সেটা পড়বে ০১/০১/০০, আর সেই সাথে শুরু হবে পৃথিবীব্যাপী বিপর্যয়। অনেকে বিশ্বাস করতো আকাশে চলমান প্লেন তখন নিচে পড়ে যাবে, বিদ্যুত বন্ধ হয়ে যাবে, সংরক্ষিত বোমাগুলো ফেটে যাবে, নিউক্লিয়ার প্লান্টগুলো গলে যাবে। তখন প্রাচীনপন্থীদের অনেকেই আধুনিক মানুষকে দোষারোপ করার সুযোগ পাবে এত বেশি কম্পিউটারের উপর নির্ভরশীল হওয়ার জন্য। বলাবাহুল্য, এর কিছুই হয়নি।

৮। ২০১২ সাল

কাছাকাছি সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত দুনিয়া ধ্বংসের ভবিষ্যতবাণী ছিল ২০১২ সালের। এ নিয়ে হলিউডে ছবিও তৈরি হয়েছে। এর উৎস ছিল মায়ান ক্যালেন্ডার। মায়ানরা হচ্ছে মেক্সিকোর এক প্রাচীন সভ্যতার অধিবাসী। তাদের ক্যালেন্ডারের ২০১২ তে সময়ের এক চক্র বা বছর শেষ হয়ে ২০১২ তে নতুন চক্র শুরু হবে। তো এইটা ভুলভাবে ইন্টারপ্রেট করে প্রচার করা হলো ২০১২ এর ডিসেম্বরে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর তা নিয়ে সে কী হৈচৈ!

৯। ২৩ এপ্রিল, ১৮৪৩

উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড রাজ্যের উইলিয়াম মিলার নামের এক কৃষক ঘোষণা করলেন যে তিনি বাইবেল স্টাডি করে জেনে গেছেন যে ঈশ্বর কখন পৃথিবী ধ্বংস করবেন। এবং সেই তারিখ হচ্ছে ১৮৪৩  সালের ২৩ এপ্রিল। মিলারের ঘোষনা শুনে তার অনেক ফ্লোয়ার তাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে অপেক্ষা করা শুরু করল কখন পৃথিবী ধ্বংস হবে। শেষ পর্যন্ত তারিখ পার হলে ব্যাপক হতাশ হলো তারা।

১০। ১৮০৬ সাল

ইংল্যান্ডের লীডস অঞ্চলে সেই সময়ে ছিল এক মুরগী ভবিষ্যত বক্তা যাকে বলা হত “The Hen Prophet”. সেই মুরগী যে ডিম পারতো সেটার গায়ে নানারকম ভবিষ্যত বাণী লেখা থাকতো। তো একবার ডিমে লেখা দেখা গেল “Christ is coming”, সেইটার অর্থ দাড়ায় পৃথিবীর ধ্বংস ঘনিয়ে আসছে। কারণ বাইবেল মতে, যীশুর পুনরায় পৃথিবীতে আসার পরই পৃথিবী ধ্বংস হবে। যাই হোক সেই ভবিষ্যৎবাণীর কারণে ১৮০৬ সালে ইংল্যান্ড ব্যাপক প্যানিকের সৃষ্টি হয়। পাঠক নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন, ডিমে কীভাবে ভবিষ্যৎবাণী আসতো!

১১। ২০১১ সাল

আমেরিকার একজন খ্রিস্টান এভেঞ্জেলিস, হ্যারল্ড ক্যাম্পিং যিনি অনেকবার পৃথিবী ধ্বংসের ভবিষৎবাণী করেছেন, এরকম একবার বললেন ২০১১ সালে নুহ-এর বন্যার ৭০০০ বছর পার হবে এবং তখন দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। তা শুনে হ্যারল্ডের ভক্তরা তাদের সব সম্পদ বেঁচে দিল, সারা আমেরিকায় বড় বড় বিলবোর্ড বানালো, যাতে মানুষ শেষ বিচারের দিনের জন্য প্রস্তুত হয় আর বারগুলোতে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়া উপলক্ষে পার্টি করা শুরু করলো। তারপর? যথারীতি দুনিয়া আগের মতই থাকলো!

১২। যেকোনো দিন!

এই ভবিষ্যৎবাণী অন্যদের মত নয়, সাবেক আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের এই সতর্কতার যথেষ্ট বাস্তব ভিত্তি আছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। এরকম চলতে থাকলে একদিন ভারত ও চীনের অর্ধেক পানির নিচে চলে যাবে, ইউরোপে আবার পুনরায় বরফযুগ দেখা দিবে। সেই হবে মানুষের সভ্যতার শেষের শুরু। পৃথিবী নামক গ্রহ হয়তো থাকবে কিন্তু থাকবে না কোন মানুষ। তেলের ব্যবহার, বনভুমি কমে যাওয়া চলতে থাকলে এই ভয়ঙ্কর সময় হয়তো এই শতাব্দীতেই আসবে।
অনেক সময় ভবিষ্যৎবাণীগুলো এসেছে বক্তার বিশ্বাস থেকে, অনেক সময় এসেছে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে, আবার কিছু কিছু সময় এসেছে শুধু মাত্র ব্যবসা করার ফিকির হিসেবে। কারণ জনগনের “ভয় পাওয়া”ও কারো কারো জন্য একটা ব্যবসা! মানুষের মধ্যে প্যানিক ছড়িয়ে তারা লাভবান হয়। কাজেই এইসব সামনের দিনে শুনলে আমাদের কমনসেন্স খাটাতে হবে আর বক্তার মোটিভ বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বলেকয়ে কি আর দুনিয়া ধ্বংস হওয়া সম্ভব?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন