রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭


চেরনোবিল বিপর্যয়: যে তিনজন বাঁচিয়েছিলেন লক্ষ মানুষের জীবন

প্রায় ৩১ বছর আগে ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত সোভিয়েত ইউক্রেন এর চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পারমাণবিক চুল্লী বিস্ফোরিত হয়ে এক প্রলয়ংকারী দুর্ঘটনা ঘটে। ইতিহাসে এটি পরিচিত চেরনোবিল বিপর্যয় হিসেবে। চেরনোবিলের এই ঘটনাটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী পারমাণবিক বিপর্যয় বলা হয়ে থাকে। সেই বিপর্যয়ের মধ্যেই এমন আরো একটি দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল যেটি মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ প্রাণসংহারী ঘটনা হতে পারত। কিন্তু নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেটা রুখে দিয়েছিলেন তিন অসমসাহসী মানুষ। দ্য চেরনোবিল ডাইভারস নামে খ্যাত চেরনোবিলের সেই বীরদের স্মরণে আজকের লেখা।
chernobyl diversশিল্পীর তুলিতে দ্য চেরনোবিল ডাইভারস
দুর্ঘটনাটি ঘটে যখন চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অপারেটররা বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাকআপ বন্ধ হয়ে গেলে সে অবস্থায় কীভাবে পারমাণবিক চুল্লী চালানো যায় তা পরীক্ষার জন্য একটি ‘স্ট্রেস টেস্ট’ করছিলেন তখন। স্ট্রেস টেস্ট মানে হল কোনো সিস্টেমের মধ্যে কৃত্রিম জরুরী অবস্থা তৈরি করে ভবিষ্যতের এমন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করা হবে সেটা পরীক্ষা করা। পরীক্ষা শুরুর সময়ে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারটি পারমাণবিক চুল্লীর মধ্যে একটি চুল্লীতে অনিয়ন্ত্রিত বিক্রিয়া শুরু হয় যার কারণে দুটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে দুটি পারমাণবিক দুর্ঘটনাকে সর্বোচ্চ মাত্রার বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর একটি ঘটেছে চেরনোবিলে, আরেকটি ঘটেছে ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাইচির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। চেরনোবিলের দুর্ঘটনার পরপরই এর পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ফলে মারা যায় ৫৬ জন যাদের মধ্যে ছিল ৯ জন শিশু। পরবর্তীতে আরও চার হাজার মানুষ এই তেজস্ক্রিয়তার কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
chernobyl-disasterবিস্ফোরণের পর চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাদাকালো ছবিকে পরবর্তীতে রঙিন করা হয়েছে
চেরনোবিল বিপর্যয়ের ভয়াবহতা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক। দুর্ঘটনার কারণে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে অন্তত ছয় লক্ষ মানুষ জীবনঝুঁকিতে রয়েছে আজও। কিন্তু এই দুর্ঘটনা আরও ভয়ঙ্কর ভাবে মানব ইতিহাসের মহাপ্রলয়ংকারী বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারত। কিন্তু সেটা হয় নি তিন জন দুঃসাহসী মানুষের দুর্লভ বীরত্বের কারণে।
চেরনোবিল দুর্ঘটনা ঘটবার পাঁচ দিন পর ১৯৮৬ সালের মে’র ১ তারিখে সোভিয়েত কর্মকর্তারা আবিস্কার করল এক ভয়াবহ তথ্য। যে পারমাণবিক চুল্লীটি বিস্ফোরিত হয়েছে সেটার কোর অর্থ্যাৎ মূল অংশটি তখনও উত্তাপে গলে চলছিল! সেই কোরের মধ্যে তখন ছিল ১৮৫ টন পারমাণবিক জ্বালানী এবং সেখানে তখনও পারমাণবিক বিক্রিয়া হচ্ছিল!
chernobyl burningবিস্ফোরণের তিন দিন পরেও বেরিয়ে আসছে তেজস্ক্রিয় ধোঁয়া
এই ১৮৫ টন পারমাণবিক জ্বালানীর ঠিক নিচেই ছিল ৫ মিলিয়ন গ্যালন ধারণ ক্ষমতার একটি পুল অর্থ্যাৎ জলাশয়। সেই পুলের পানি ব্যবহৃত হত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শীতলীকরণে কাজে। তো সেই পুল আর বিস্ফোরিত চুল্লীর কোরের মধ্যে ছিল কেবলমাত্র একটা কনক্রিট স্ল্যাব, মানে জমাটবাঁধা পাথরের তৈরি ঢাকনা । যদিও স্ল্যাবটি যথেষ্ট মোটা ছিল, কিন্তু কোরটির ভেতরে তো ছিল পারমাণবিক জ্বালানী! আগুন নেভানোর জন্য অগ্নিনির্বাপন কর্মীরা প্রচুর পানি ব্যবহার করছিল আর সেই সাথে হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হচ্ছিল বালি, কাদামাটি ও বোরন পাউডার। আগুন তৎক্ষণাৎ নেভানো যায় নি এবং এই পানি আর হেলিকপ্টার থেকে ফেলা দ্রব্যগুলো জমা হচ্ছিল চুল্লীর কোরের নিচের অংশে। এগুলো একসাথে মিশে আগ্নেয়গিরির লাভার মত এক ধরণের মিশ্রণ তৈরি করে এবং স্থানটি উত্তপ্ত থাকায় ধীরে ধীরে মিশ্রণটি স্ল্যাবের মধ্যে ছিদ্র তৈরি করে এর মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। এভাবে স্ল্যাবটি গলে গিয়ে নিচের পানিতে কোরের পারমাণবিক জ্বালানী মিশিয়ে দেবে, এমন কিছুই ঘটতে যাচ্ছিল তখন।

chernobyl_lava_flow

চুল্লী থেকে বেরিয়ে আসছে লাভা
আর যদি গলতে থাকা কোরটি নিচের পানি স্পর্শ করতে পারে তাহলেই ঘটবে এক মহাবিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে গোটা ইউরোপের অধিকাংশ এলাকায়। চেরনোবিল বিপর্যয়ের পঞ্চম দিনে এসে এমন এক দুর্ঘটনার সম্ভাবনার তথ্য পাওয়া গেল যেটার কাছে প্রথম দিনের বিস্ফোরণ কিছুই নয়।
বিজ্ঞানীদের হিসেব মতে, যদি সেই জ্বালানী সহ গলিত কোর পানি স্পর্শ করত তাহলে বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট উত্তাপে অন্য তিনটি চুল্লীর পারমাণবিক জ্বালানীও বাষ্পীভূত হত। তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ত অন্তত তিন কোটি মানুষের ব্যবহার্য পানিতে। স্কুল অব রাশিয়ান এন্ড এশিয়ান স্টাডি’র গবেষকদের মতে, এই মহাবিস্ফোরণের ফলে গোটা ইউরোপের কমপক্ষে অর্ধেক অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হত এবং ইউরোপ, ইউক্রেন ও রাশিয়ার অনেক অংশ অন্তত পাঁচ লক্ষ বছরের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ত।
chernobyl reactorযাদুঘরে সংরক্ষিত বিস্ফোরিত পারমাণবিক চুল্লীর মডেল, মাঝখানে চুল্লীর ঢাকনাটি উড়ে গেছে বিস্ফোরণে
যাই হোক, ঐ সময় সেখানে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা জানালেন, গলতে থাকা কোরটি ধীরে ধীরে কনক্রিট স্ল্যাবের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করছে এবং প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে পানির কাছে যাচ্ছে।
ইঞ্জিনিয়াররা এই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা কীভাবে থামানো যায় তার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তারা একটা সমাধান বের করলেন। পুলের ভেতরে পানি প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য যে পাইপ রয়েছে তার ঢাকনা খোলা বা বন্ধ করার জন্য রয়েছে এক জোড়া গেট ভালভ। তিন জন মানুষ পুলের মধ্য দিয়ে সাঁতার কেটে যাবে গেট ভালভগুলো যেখানে আছে সে জায়গাটায়। পুলের গেট ভালভ খুলে দিলে পানি আটকে রাখার ঢাকনা খুলে যাবে এবং জমে থাকা পানি বের হয়ে যাবে নির্গমন পথ দিয়ে। স্ল্যাব গলিয়ে কোরটি পানির সংস্পর্শে আসার আগেই করতে হবে কাজটা।
এই পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারলে আসন্ন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হয়ত ঠেকানো যাবে, কিন্তু পুলের মধ্যে নেমে কাজতা করবে কারা? পারমাণবিক চুল্লীর গলতে থাকা কোরের ঠিক নিচের ঐ পুলের পানি সম্ভবত ঐ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অনিরাপদ জায়গা। ওই স্থানের তেজস্ক্রিয়তা সেই তিনজনের জীবন বাতি যে চিরদিনের জন্য নিভিয়ে দেবে সেটা বলাই বাহুল্য। নিজ জীবন বিলিয়ে দিয়ে সেখানে সাঁতার কাটতে যাবে এমন কেউ কি সেখানে ছিল?

two of three

তিনজনের মধ্যে দুজনের ছবি পাওয়া যায়
ছিলেন। এগিয়ে এলেন তিনজন। এবং তারা নিশ্চিতভাবেই জানতেন, এই কাজের পরিণতি মৃত্যু। ভ্যালেরি বেজপালভ এবং অ্যালেক্সি আনানেকো ছিলেন বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের প্রকৌশলী আর বরিস বারানভ ছিলেন প্ল্যান্টের একজন কর্মী। প্রকৌশলী দুজন জানতেন ভালভ দুটো কোথায় আছে, বরিস তাদের সঙ্গী হলেন পানির নিচে কাজ করে এমন একটি ল্যাম্প নিয়ে।
পর দিন তিনজন সাঁতারের পোশাক পড়ে নামলেন সেখানে। যাবার আগে শুধু বলে গেলেন তাদের মৃত্যুর পর যেন তাদের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়া হয়।
পুলের ভেতরটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। কপালের কী দুর্গতি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের কাছে থাকা ল্যাম্পটির আলো ফিকে হয়ে এল।
আলো আঁধারের মধ্যে সাঁতরাতে হচ্ছে, এবং প্রতিটা মুহূর্তে মৃত্যুর একটু একটু করে কাছে যাচ্ছেন তিনজন। কিন্তু গেট ভালভ পাওয়ার আগ পর্যন্ত খুঁজে যেতেই হবে। এর উপর নির্ভর করছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন মৃত্যুর সিদ্ধান্ত। এমন সময় হঠাৎ নিভে গেল সাথের ল্যাম্পটি। গাঢ় অন্ধকার নেমে এল। কিন্তু ক্ষীণ আশা আছে তখনও, কারণ বাতি নেভার আগ মুহূর্তেই এর আলোতে তাদের চোখে পড়েছিল একটা পাইপ। দুই ইঞ্জিনিয়ার সেই পাইপটির কাছে চলে গেলেন। তারা জানতেন, সেই পাইপ ধরে এগিয়ে গেলে খুঁজতে থাকা ভালভ দুটো পেয়ে যাবেন।
তিন ডুবুরি পাইপের পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন। চারিদিকে কোনো আলো নেই, তাদের শরীরকে প্রতি মুহূর্তে অল্প অল্প করে ধবংস করে দিতে থাকা তেজস্ক্রিয়তা থেকে বাঁচবার মত কোনো সুরক্ষা নেই, কেবল সেই অন্ধকারের মধ্যে কোথাও আছে দুটো গেট ভালভ যেগুলো খুঁজে পেলে বাঁচবে লাখো প্রাণ। এক সময় পাওয়া গেল সে দুটো।
তারা ভালভ দুটো খুলে দিলেন। পানি বের হয়ে যেতে লাগল পাইপের মধ্য দিয়ে। পুল খালি হতে শুরু করল ধীরে ধীরে। মহাবিস্ফোরণ ঠেকিয়ে দিলেন তিনজন।
তিন দুঃসাহসী ডুবুরি সাঁতরে ফিরলেন এরপর, উঠে এলেন পানি থেকে। সেখানে অপেক্ষায় থাকা কর্মী আর সৈন্যরা সেই বীরদের জড়িয়ে ধরল। তখনকার পত্রিকার রিপোর্টারদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, সেই দুঃসহ সময়ের মধ্যেও এই তিনজন মানুষের সাফল্যে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন সেখানে উপস্থিত অনেকেই।
এক দিনের মধ্যেই চতুর্থ চুল্লীর নিচে থাকা পুলের সমস্ত পানি বেরিয়ে গেল। যে মহাবিস্ফোরণের আশঙ্কা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা তার ভয়ানক পরিণতির হাত থেকে বেঁচে গেল অসংখ্য মানুষ।
memorialচেরনোবিল বিপর্যয়ে নিহতদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য
সেই তিনজনের কী হল? পনের দিনের মধ্যে ভ্যালেরি বেজপালভ এবং অ্যালেক্সি আনানেকোর শরীরে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে চূড়ান্ত ক্ষতি দেখা গেল, মস্কোর একটি হাসপাতালে মারা গেলেন দুজনই। বরিস বারানভ মারা গেলেন আর ক’দিন পরেই। মারা যাবার পরেও তাদের শরীর থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়ে যাওয়ার কারণে কবর দেয়ার আগে সীসা দিয়ে ঝালাই করে দেয়া হয়েছিল তাদের কফিন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দ্য চেরনোবিল ডাইভারস নামে খ্যাত এই তিন ব্যক্তির অভিযান ও পরিণতি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন ইংল্যান্ডের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক এন্ড্রু লেথারব্যারো। ২০১৬ সালে তার প্রকাশিত বই ‘Chernobyl 01:23:40’ তে তিনি উল্লেখ করেছেন এই তিনজনের প্রত্যেকেই ছিলেন বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের সাধারণ কর্মী এবং তারা যখন পানিতে নামে তখন সেখানে হাঁটু পরিমাণ পানি ছিল এবং পরবর্তীতে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে তাদের মৃত্যু হয় নি। লেথারব্যারো জানান, তাদের একজন হৃদরোগে মারা গেছেন ২০০৫ সালে এবং অন্য দুজন অন্তত ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় নি। যদিও তিনি স্বীকার করতে ভোলেন নি, তারা তিনজন যদি বেঁচেও থাকেন তবুও এই দুঃসাহসী কাজের গুরুত্ব কোনো ভাবেই কমে না।
মাত্র আট মাস আগে প্রকাশিত এই বইয়ের তথ্যের সত্যতা জানতে আরও গবেষকদের বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে একটি ব্যাপারে সকলেই একমত, বেঁচে থাকুন কিংবা মারা যান, এই তিন অসমসাহসী মানুষ মানবজাতিকে ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম মৃত্যুর মিছিলের অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা করেছিলেন। জীবনের ঝুঁকি তো অবশ্যই ছিল। সেটা জেনেও তারা নেমে পড়েছিলেন পুলের মধ্যে। এর চেয়ে দুঃসাহসী অভিযান আর কী হতে পারে! অমন কঠিন মুহূর্তে জীবন বাজি রেখে যারা এগিয়ে এসেছিলেন অজস্র মানুষের প্রাণ বাঁচাতে, সেই মহত্তম তিন মানবকে পৃথিবী অনন্তকাল স্মরণ করবে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা নিয়ে।


মাতা হারি: দুর্ধর্ষ স্পাই পরিচয়ের আড়ালে এক স্বপ্নভঙ্গের গল্প

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দুর্ধর্ষ স্পাই হিসেবে আজও লোকের মুখে ঘুরে ফিরে আসে একটি নাম, মাতা হারি। জার্মানির হয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির কারণে ফায়ারিং স্কোয়াডে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল আজ থেকে একশ বছর আগে, ১৯১৭ সালে। পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম গুপ্তচরদের তালিকা করলেই সবার আগে চলে আসে তার নাম। এসপিওনাজের বেপরোয়া জগতে এমন স্পাই হিসেবে বিশেষিত হবার মত কী এমন দুর্দান্ত খেল দেখিয়েছিল মাতা হারি? আসলেই কি মাতা হারি এত ভয়ঙ্কর এক মানুষ ছিল? আদৌ কি তার গুপ্তচরবৃত্তির কারণে এদিক-ওদিক হয়ে গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল? চলুন জানার চেষ্টা করি কী করেছিল মাতা হারি, কেমন ছিল তার গুপ্তচর জীবন, কী স্বপ্ন দেখেছিল এই মানুষটি, কেন তার মৃত্যু হল নিষ্ঠুর বিচারে।
মার্গারেটা গিরট্রুইডা জিলে জন্মেছিল ১৮৭৬ সালের ৭ আগস্ট। তার বাবা ছিল টুপি বিক্রেতা, তবে জমকালো পোশাক আর দাম্ভিক চাল চলনে অভ্যস্ত। ফ্রিজল্যান্ড ও উত্তর-জার্মান রক্তের হলেও মার্গারেটার কালো চুল, বাদামী চোখ আর জলপাই আভার গায়ের রঙ দেখে আধা-ভারতীয় কিংবা আধা-ইন্দোনেশীয় বলে ভুল হত।
মার্গারেটার তের বছর বয়সে বাবার ব্যবসা পথে বসল। সেই সাথে ঘটল বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ। মার্গারেটার প্রতি অনুরক্ত বাবা তখন তার উপরেও মেজাজ দেখানো শুরু করল এবং দূরে সরে গেল মেয়ের কাছ থেকে। বয়স পনের হবার আগেই মারা গেল তার মা। ওই বয়সেই পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি দীর্ঘকায় লাজুক কিন্তু প্রাণবন্ত তরুণী মার্গারেটা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করল পুরুষদের কাছে সে খুবই মোহনীয় এবং কামনার মানুষ হয়ে উঠছে। তার স্কুলের হেডমাস্টার পর্যন্ত তার প্রেমে পড়ে গেল। বয়স আঠারো হবার পর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হল হেগ শহরে আত্মীয়দের সাথে থাকতে।

1905

মাতা হারি, ১৯০৫
ওখানে গিয়ে তার মন টিকছিল না। অনভ্যস্ততায় অস্থির হয়ে উঠছিল মার্গারেটা। এমন সময় এক কাণ্ড করে বসল সে। স্থানীয় পত্রিকার এক বিজ্ঞাপনের জবাব পাঠালো। আর সেটা ছিল একটা ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন যেটা দিয়েছিল পাত্র স্বয়ং। “ইন্ডিজের সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, হল্যান্ডে আছেন ছুটিতে, মনের মত একজন পাত্রী খুঁজছেন” এই ছিল বিজ্ঞাপনের ভাষা। সেই ক্যাপ্টেন রুডলফ ম্যাকলিউড এর সাথে দেখা করল মার্গারেটা, তিন মাস পর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। পরবর্তী সাত বছর তারা ছিল তৎকালীন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ, যেটা আজকের ইন্দোনেশিয়া, সেখানে। দাম্পত্য জীবন এর মধ্যেই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল মার্গারেটার কাছে। তার দুই সন্তানকে বিষ প্রয়োগ করেছিল স্থানীয় এক ভৃত্য, মারা গেল তার বড় ছেলেটা। আর ম্যাকলিউডের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিয়ম করে প্রতিদিন মার্গারেটার সাথে হিংস্র আচরণ করা। ১৯০২ সালে অবশেষে সে বিচ্ছেদে বাধ্য হল, ইতিমধ্যে তারা ফিরে এসেছিল হল্যান্ডে। ম্যাকলিউড তাদের ছোট মেয়েটিকে জোর করে রেখে দিল নিজের কাছে।

mata hari with husband

বিয়ের পর, স্বামীর সাথে মাতা হারি
মার্গারেটার বয়স তখন ২৭, সে চলে এল প্যারিসে। তার নতুন জীবন শুরু হল শিল্পীদের মডেল হিসেবে। বেশি দিন টিকতে পারল না, আবার ফিরে গেল হল্যান্ডে। সেখানে তার দেখা হল হেনরি দ্যু মার্গুয়েরি নামক এক ফরাসি কূটনীতিকের সাথে। তার সাথেই মার্গারেটার প্যারিস ফিরে আসা হল, তার মিসট্রেস হিসেবে। এবার শুরু হল নৃত্যশিল্পী হিসেবে তার জীবনের বিখ্যাত সময়টি। মার্গুয়েরি প্যারিসের নানান মহলে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল গঙ্গার ধারের এক মন্দির থেকে আসা পবিত্র পূজারী হিসেবে, যার অর্চনার মাধ্যম হল নৃত্য। মার্গারেটা তার নাচের মধ্যে নিয়ে এল ইন্দোনেশিয়ায় দেখা সেই ভঙ্গিমা আর মোহনীয় মুদ্রাগুলো। সাথে যোগ করল অঙ্গাবরণ উন্মোচন করে স্বল্পবসনা নাচ যেটা দেখে মনে হত যেন এই পূজারই কোনো একটা রীতি। তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল মার্গারেটা। নতুন নাম ধারণ করল সে এবার- মাতা হারি। ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ ‘ভোরের আলো’।

mata-hari-1907

মাতা হারি, ১৯০৭। ছবিতে শিল্পীর কল্পনায় রঙের মিশেল দেয়া হয়েছে।
১৯০৫ থেকে শুরু করে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার আগ পর্যন্ত মাতা হারি উপভোগ করেছিল দুর্দান্ত সেলিব্রেটির মর্যাদা। মাদ্রিদ, মিলান, মন্টে কার্লো আর প্যারিসে সে ছিল পরম পূজনীয়। কখনো কখনো সিসিলির থিয়েটারে কিংবা অভিজাত ব্যক্তিদের প্রাসাদে গিয়েও নৃত্য উপস্থাপন করত মাতা হারি। তার নাম তখন উচ্চারিত হত ঘরে ঘরে, কেননা সে ছিল ইউরোপে স্বল্পবসনা নাচের প্রথম ও প্রবাদপ্রতীম শিল্পী, সবচেয়ে বড় কথা, সে যুগের বিখ্যাত অনেক পুরুষের পরম আরাধ্য নাম ছিল মাতা হারি।
ফ্রান্সের প্রথম সারির কূটনীতিক থেকে শুরু করে জার্মানির যুবরাজ পর্যন্ত ছিল মাতা হারির স্বপ্নে বিভোর। তার সত্যিকারের বন্ধু ছিল খুব অল্প, আর এই এগারো বছর ধরে মার্গুয়েরিই ছিল মাতা হারির নিকটতম। তার প্রতি মানুষের আকর্ষণের মূলে অবশ্যই ছিল তার মোহনীয় আর অভিনব নৃত্য প্রতিভা। নগ্নতাকে সে নিয়ে গিয়েছিল শিল্পের পর্যায়ে, ধর্মীয় অর্চনার আবরণে তার নৃত্যের মুদ্রাগুলো ছিল মনোমুগ্ধকর।

mata hari 1906

মাতা হারি, ১৯০৬
এর মধ্যেই একবার সে গেল বার্লিনে। সেখানের মেট্রোপলে নাচবার সময় তার বিরুদ্ধে অসভ্যতার অভিযোগ আসলেও এক পুলিশ অফিসারের সাথে সখ্যতা করে সেই অভিযোগ চাপা দেয়ার ব্যবস্থা করল মাতা হারি। এই ছোট্ট ঘটনাটিই তার পরবর্তী জীবনে ভয়ানক পরিণতির জন্য অনেকখানি দায়ী ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়ে আগস্টেই মাতা হারির নিজভূমি হল্যান্ডে ফিরে যাবার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সে থাকতে চাইল প্যারিসে, ফলাফল, জার্মানরা দখলে নিল তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, স্বর্ণ এমনকি পোশাক পর্যন্ত। নিঃস্ব হয়ে মাতা হারি ফিরে এল হল্যান্ডে।
৩৮ বছর বয়স তখন তার, হঠাৎ সেখানে দেখা হয়ে গেল এক পুরনো প্রেমিকের সাথে। সেই প্রেমিক ছিল এক সম্ভ্রান্ত ব্যারন, আমস্টারডমে নিজ পরিবারকে রেখে হেগ শহরে মাতা হারিকে সে নিয়ে দিল একটা জাঁকজমকপূর্ণ বাড়ি। যদি সে পুরো যুদ্ধকালীন থাকত সেই বাড়িতে, তাহলে হয়ত ইতিহাসের কোনো এক কোণায় স্বল্পবসনা নৃত্যের পথিকৃৎ হিসেবেই ছোট্ট একটা জায়গা পেত মাতা হারি। কিন্তু ইতিহাস যার জন্য নির্ধারণ করেছিল বহুল উচ্চারিত কিন্তু বেদনাদায়ক এক পরিণতি, তার তো সেখানে আবদ্ধ হয়ে থাকলে চলে না।
দীর্ঘদিন একলা থাকতে থাকতে আর শুধুমাত্র সেই ব্যারনের সঙ্গ পেতে পেতে মাতা হারির বিরক্তি ধরে গেল। ১৯১৫ সালের ক্রিস্টমাসে তিন সপ্তাহের জন্য সে বেড়াতে গেল প্যারিসে। যুদ্ধ যখন গোটা ইউরোপকে পাল্টে দিচ্ছে এমন সময় মাতা হারির মত জনপ্রিয় আর পরিচিত মুখ যেখানেই থাকুক না কেন নজরদারিতে পড়ে যাবে এই স্বাভাবিক বোধটুকুকে ব্যহত করল তার উদ্ধত আর আত্মকেন্দ্রীক স্বভাব। এরপর সে গেল ইংল্যান্ড ভ্রমণে। সেখানে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা নজর রাখতে শুরু করল তার চলাফেরার উপর। তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারল মাতা হারি বার্লিনে গিয়েছিল এবং সেখানে জার্মান পুলিশ অফিসারের সাথে তার সখ্যতা হয়েছিল। এইটুকু থেকেই তারা ধরে নিল মাতা হারি একজন জার্মান এজেন্ট এবং সে অনুসারেই তারা তথ্য পাঠালো ফ্রান্সের কাছে।

1914

মাতা হারি, ১৯১৪
কয়েক মাস পর মাতা হারি ফিরে এল প্যারিসে। দু’জন পুলিশ ইনস্পেকটর সিভিল পোশাকে তাকে অনুসরণ করছিল যারা তার গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পেল না। চারিদিকে কড়া নজরদারির কথা জেনেও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মাতা হারি এই অবরুদ্ধ শহরে ছয়টি মাস কাটিয়ে দিল। আর এই ছয় মাস এখানে থাকার কারণ ছিল এমন এক ঘটনা যা তার মত বারবণিতার জীবনে ঘটতে পারে, এটা সে ভাবতেও পারে নি। প্রেমে পড়েছিল সে।
প্যারিসে মাতা হারির পরিচয় হয়েছিল ভ্লাদিমির দ্যু ম্যাসলফ এর সাথে, যে ছিল ফরাসি বাহিনীতে কর্মরত ২১ বছর বয়সী এক রাশিয়ান ক্যাপ্টেন। প্রেম হয়ে গেল এই দুজনার কিন্তু ম্যাসলফকে দ্রুতই ফিরে যেতে হল যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে জার্মানদের ভয়ানক মাস্টার্ড গ্যাসের আক্রমণে তার বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেল। যুদ্ধাহত এই তরুণ মাতা হারির মনে জন্ম দিল দারুণ এক মায়ার। সেই ডাচ ব্যারনের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের বড় অংশ সে ব্যয় করতে লাগল ম্যাসলফকে ভালো ভালো খাবার কিনে দেওয়া কিংবা তার জুয়ার ঋণ পরিশোধের জন্য।
এই দুজনের প্রেমের দৃষ্টি কিন্তু ভিন্ন ছিল। মাতা হারির বয়স তখন চল্লিশের কোঠায়, নৃত্যশিল্পীর জীবন সে ছেড়ে দিয়েছে। অভিজাত কোনো লর্ডকে বিয়ে করে সংসার করবার সম্ভাবনা তখন আর নেই বললেই চলে। কিন্তু সে জিতে নিয়েছিল হ্যান্ডসাম এক অফিসারের মন যে কিনা যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তত একশ’ জার্মান সৈন্যের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। আর এদিকে ম্যাসলফ যদিও জানত তার প্রেমিকার সেই জৌলুস আর নেই, কিন্তু মাতা হারি তো একটা নাম! একটা ফ্যান্টাসি! যুদ্ধাহত এক সৈনিক যার পরবর্তী কাজ হতে যাচ্ছে পরিখা খননের দলে যোগ দেয়া, সেখানে যার হয়ত আর পাঁচ মাসও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই, সে মাতা হারিকে কেবল প্রেমিকা হিসেবেই পেল না, পেল এক পর আর্দ্রতায় আপন করে নেয়া বন্ধুকে। দুজনের এই প্রেমের বন্ধন যে মাতা হারিকে আটকে ফেলছিল ভয়ানক কোনো ভবিষ্যতের জালে, সে তা টেরও পায় নি।
ঘটনার সূত্রপাত হল তখন, যখন যুদ্ধক্ষেত্রের খুব কাছেই ভিত্তেল নামক জায়গায় একটা হাসপাতালে ম্যাসলফ ভর্তি হল এবং মাতা হারি তাকে দেখতে যেতে চাইল। সেখানে যেতে হলে বিশেষ পাশ দেখাবার প্রয়োজন ছিল। সেই পাশ জোগাড় করতে গিয়ে তার পরিচয় হল গিওর্গি ল্যাঁদু’র সাথে। খাটো গড়ন, যত্ন করে ছাঁটা দাঁড়ি, পরিশীলিত গোঁফ আর ঢেউ খেলানো চুলের গোয়েন্দা অফিসার ক্যাপ্টেন গিওর্গি ল্যাঁদু ছিল ফরাসি বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ১৯১৬ সালের আগস্টে প্রথম সাক্ষাতেই মাতা হারিকে সে জানাল, ব্রিটিশদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে যে মাতা হারি একজন জার্মান স্পাই।
captain_georges_ladouxগিওর্গি ল্যাঁদু
ল্যাঁদু ভাবছিল, এই তো সুযোগ! মাতা হারি যদি সত্যি জার্মান স্পাই হয়, তাহলে তাকে এই সুবিধাটুকু দেয়ার বদলে ফ্রেঞ্চ স্পাই হয়ে ডাবল এজেন্টের ভূমিকা নেয়ার প্রস্তাব দেয়া যাবে। আর যদি সে জার্মান স্পাই না হয়, তাহলে তো হলই, কাজটা আরও সহজ হবে। যে করেই হোক তাকে ফরাসি গুপ্তচর বানানোর জন্য আগ্রহী ছিল ফরাসী গোয়েন্দা অফিসার ল্যাঁদু।
আলোচনা পর্বে তাই ল্যাঁদু মাতা হারিকে প্রস্তাব দিল তার এত দিনের গড়ে তোলা বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে সখ্যতার সূত্র ধরে ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য। মাতা হারি জানালো সে ভেবে দেখবে যদি মূল্যটা উপযুক্ত হয়। তখনই ল্যাঁদু তাকে ভিত্তেলের সেই হাসপাতালে যাবার বিশেষ পাশ দিয়ে দিল। মাতা হারি হয়ত তার প্রেমিকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেল, কিন্তু সে জানত না মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়ে ফেলেছিল সে।
ল্যাঁদুর কাছে ভিত্তেল ছিল মাতা হারির জন্য প্রথম পরীক্ষা। যদি সে সত্যিই শুধু ম্যাসলফের প্রতি ভালোবাসার কারণে তার সাথে দেখা করে এবং তার কাছ থেকে কোনো রকম সামরিক তথ্য জোগাড় না করে, তাহলে বোঝা যাবে তাকে দিয়ে কাজ হবে। সে তার জার্মান অভিজাত ব্যক্তিদের সাথে খাতির আর জার্মান ভাষার দক্ষতার জোরে জার্মানদের অবশ্যই বিশ্বাস করাতে পারবে সে তাদেরই একজন, কিংবা যদি ব্রিটিশদের দেয়া তথ্য ঠিক হয়, সে এখনও তাদেরই একজন। এই ভেবে পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে লাগল ল্যাঁদু।
পুলিশ রিপোর্ট জানা গেল ম্যাসলফের সাথে কাটানো একটা সপ্তাহে মাতা হারি সন্দেহজনক কিছু করেনি। তাই সে যখন ভিত্তেল থেকে প্যারিসে ফিরল, ল্যাঁদু আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ফরাসি স্পাই হিসেবে নিযুক্ত করল। মাতা হারি ল্যাঁদুকে সরাসরি জানাল, এ কাজটি সে করতে যাচ্ছে শুধুই টাকার জন্য কারণ সে ম্যাসলফকে ভালোবাসে এবং যুদ্ধাহত হওয়ায় সে উপার্জনে অক্ষম। কিন্তু সে ম্যাসলফকে নিয়ে সংসার করার মত অর্থশালী হতে চায়। স্পাই হিসেবে মাতা হারিকে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হল বেলজিয়ামে।
শুরু হল গুপ্তচর মাতা হারির জীবন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৫০,০০০ সৈন্যের মৃত্যুর জন্য মাতা হারির গুপ্তচরবৃত্তিকে দায়ী করার যে কাহিনী তৈরি হয়েছিল, তা কি সত্যি, নাকি শুধুই এক স্বাপ্নিক নারীর বাঁচার আকুলতাকে ফাঁদে ফেলে তৈরি করা মিথ্যে গল্প



দুর্ধর্ষ স্পাই মাতা হারির স্বপ্নভঙ্গের শেষ গল্প

রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১০০ বছর আগে ১৯১৭ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মাতা হারির জীবনের নানান বাঁকের গল্প ছিল এই লেখার প্রথম পর্বে। যুদ্ধাহত এক তরুণ অফিসার ভ্লাদিমির দ্য ম্যাসলফ এর সাথে প্রেমের সম্পর্কের পর দু’জনার সুখের সংসার গড়বার স্বপ্নে বিভোর মাতা হারিকে জার্মানির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য একরকম বাধ্য করেছিল ফ্রান্সের গোয়েন্দা অফিসার ক্যাপ্টেন গিওর্গি ল্যাঁদু। প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে মাতা হারিকে পাঠানো হয়েছিল বেলজিয়ামে। সেখান থেকে শুরু হল মাতা হারির জীবনের বেদনার দীর্ঘশ্বাসে ভারাক্রান্ত পরবর্তী জীবনের আলেখ্য।
mata hari 2
মাতা হারি, সাদাকালো ছবিতে শিল্পীর কল্পনায় রঙের মিশেল
বেলজিয়ামে গিয়ে মাতা হারির কাজ ছিল একজন প্রাক্তন প্রেমিকের মাধ্যমে সেখানে কর্মরত একজন জার্মান জেনারেলের সাথে পরিচিত হওয়া। সেই জেনারেলের সাথে প্রণয়ের অভিনয় করে তার মাধ্যমে মাতা হারি পৌঁছে যাবে জার্মানির ক্রাউন প্রিন্স যুবরাজ উইলহেম এর কাছে। আর যুবরাজের কাছ থেকে জার্মানির যুদ্ধসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাবে ফ্রান্সে। এ কাজের জন্য ল্যাঁদুর কাছে পারিশ্রমিক হিসেবে মাতা হারি দাবি করল এক মিলিয়ন গোল্ড ফ্রাঁ। ল্যাঁদু তাকে বলল হেগ শহরে যেতে, সেখানে একজন এজেন্ট তার সাথে যোগাযোগ করবে। সে যেন স্পেন হয়ে সেখানে যায়।
নভেম্বরের ৬ তারিখে মাদ্রিদে রাত কাটিয়ে পরদিন মাতা হারি জাহাজে রওনা হল। সেখানে ব্রিটিশ সৈন্যরা রুটিনমাফিক সার্চ করতে এল। কী নিদারুণ দুর্ভাগ্য তার! এক ব্রিটিশ কনস্টেবল অন্য এক ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত জার্মান স্পাইয়ের চেহারার সাথে মিল দেখে তাকে সেই নারী ভেবে গ্রেফতার করে বসল। লন্ডনে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল তাকে। সেখানকার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে মাতা হারি জানাল সে ল্যাঁদুর হয়ে কাজ কররছে। কিন্তু ল্যাঁদুর কাছ যখন খবর পাঠানো হল, সে জবাব দিল, মাতা হারিকে সে চেনে না এবং তাকে যেন স্পেনে ফেরত পাঠানো হয়। সম্ভবত নিজের গুপ্তচরকে ব্রিটিশদের কাছেই এভাবে গ্রেফতার হবার ঘটনা শুনে ল্যাঁদুকেই আবার ব্রিটিশরা বোকা ভাববে কিনা এই ভেবে ল্যাঁদু এই জবাব দিয়েছিল। ফলে ব্রিটিশদের আর কোনো সন্দেহ রইল না যে মাতা হারি জার্মান স্পাই!
তিন দিন পর মাতা হারিকে স্পেন পাঠানো হল। সেখান থেকে সে আবার ল্যাঁদুকে চিঠি লিখল তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এবং নির্দেশনা জানতে চেয়ে। ল্যাঁদু কোনো জবাব পাঠাল না।
mata-1
মাতা হারি
তখন ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। মাতা হারিকে কোন নির্দেশনা পাঠায় নি ল্যাঁদু। এদিকে তার টাকা ফুরিয়ে আসছে ফলে মাদ্রিদ ছেড়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। তখন মাতা হারি ভাবল সে নিজ দায়িত্বেই জার্মানদের খবর ল্যাঁদুর কাছে পাঠাবে তাহলে হয়ত কোনো জবাব পেতে পারে। এই ভেবে সে জার্মান সামরিক দূত মেজর আর্নোল্ড ক্যালের বাড়িতে তার সাথে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করল।
মাতা হারির সাথে দেখা হবার পর মেজর ক্যালে শুরুতেই তার কথাবার্তা শুনে ধরে ফেলেছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু সেটা সে বুঝতে দেয় নি। প্রথম দিনই ক্যালে তাকে জানালো সে মরোক্কোর ফরাসী অঞ্চলে কিছু জার্মান ও তুর্কি অফিসারকে পাঠানোর জন্য একটা সাবমেরিন জোগাড়ে ব্যস্ত। সে রাতে মাতা হারি ল্যাঁদুকে লিখে পাঠালো এই তথ্য, সাথে ক্যালের উল্লেখ করা একজন জার্মান এজেন্টের নামও জানিয়ে দিল। এদিকে ল্যাঁদু এর আগেই সাবমেরিনের গল্প জেনে গিয়েছিল ফরাসি গোয়েন্দাদের মাধ্যমে, এটাও জানত যে এই গল্প আর এজেন্টের নাম দুটোই ভুয়া। আসলে মেজর ক্যালে চাইছিল মাতা হারিকে ফরাসিদের কাছেই ফাঁসিয়ে দিতে। গুপ্তচরবৃত্তিতে যাকে বলা হয় বিষাক্ত তথ্য প্রদান অর্থাৎ সত্য আর মিত্থ্যার মিশেলে কিছু মামুলি তথ্য দেয়া। তেমনটাই ক্যালে মাতা হারিকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছিল যাতে মনে হয় গুপ্তচর হিসেবে সে ফ্রান্সের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। আরও দু’দিন ধরে ক্যালে এভাবে তাকে তথ্য দিতে লাগল, সেও ওগুলো ফ্রান্সে পাঠালো, এদিকে ল্যাঁদু আগে থেকেই এসব তথ্য জেনে বসে আছে।
মাতা হারি ভাবতে লাগল সে হয়ত জার্মান মেজরকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে যে সে জার্মান-অন্তপ্রাণ। সে বিশ্বাস আরও জোরালো করতে সে ফরাসিদের ব্যাপারে আড্ডা আর পত্রিকা থেকে নেয়া কিছু অগুরুত্বপূর্ণ তথ্য ক্যালের কাছে দিল। ক্যালেও খুশি হবার ভান করে বিনিময়ে তাকে কিছু টাকা দিল।
টানা তিন দিন গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করে মাতা হারি ভাবল সে হয়ত এর মধ্যে যথেষ্ট কাজ করেছে। এখন ফ্রান্সে ফিরে এই সফল অ্যাসাইনমেন্টের জন্য পারিশ্রমিক নেয়ার পালা। ১৯১৭ এর জানুয়ারির ৪ তারিখে সে প্যারিসে ফিরে দেখল ল্যাঁদু তার সাথে দেখাই করতে চাইছে না আর ওদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ম্যাসলফ কোথায় আছে সেটাও সে জানে না।
mata 3
মাতা হারি, ১৯১৫
১৯১৭ সালের শুরুর দিকে মিত্র বাহিনী হতাশ হয়ে পড়ছিল, বিশেষত ফ্রান্স। যুদ্ধের কারণে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ব্যতীত কোনো অর্জনই তাদের আসে নি। কেবল ১৯১৬ এর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন এই পাঁচ মাসে ফ্রান্স হারিয়েছিল সাড়ে তিন লক্ষ সৈন্য। মাতা হারির চারপাশ ভয়ঙ্কর অসহায় হয়ে উঠল। ল্যাঁদুর কোনো জবাব তো নেই, তার উপর ম্যাসলফের সাথে যখন তার দেখা হল, সে জানালো প্যারিসের রাশিয়ান অ্যাম্বাসি থেকে তথ্য পেয়ে তার কমান্ডিং অফিসার তাকে নিষেধ করেছে মাতা হারির সাথে সম্পর্কে না জড়াতে। আরও কয়েক সপ্তাহ ল্যাঁদুর খোঁজ করার পর তাকে জানানো হল ল্যাঁদুকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে অন্য এলাকায়। ইতিমধ্যে তার টাকাও শেষ হয়ে আসছিল।
এদিকে তার অজান্তেই আরও অনেক বড় দুর্গতি অপেক্ষা করছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জার্মান গুপ্ত তথ্য পাঠানোর সাইফার কোড জেনে ফেলেছিল এবং সেসব তথ্য মিত্র বাহিনীকে সরবরাহ করছিল। ১৯১৬ সালে জার্মানরা নতুন কোড বসিয়ে সেটাকে নিরাপদ ভাবলেও ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সেই কোডের মর্মও উদ্ধার করে ফেলে।
ঘটনাটা জানার জন্য আবার ফিরতে হবে ডিসেম্বরে। মাতা হারি তখন মাদ্রিদে নিজ দায়িত্বে মেজর ক্যালের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করছে। আইফেল টাওয়ারের উপর স্থাপিত রেডিওতে একটা মেসেজ এল ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে। সাইফার কোড উদ্ধার করে জানা গেছে মেজর ক্যালে তার উর্ধতন কর্মকর্তাদের তথ্য পাঠাচ্ছেন একজ ‘H21’ কোডধারী স্পাইয়ের দেয়া তথ্য অনুসারে, আর এসব তথ্য ফরাসি বাহিনীকে নিয়ে। ওই যে মাতা হারি কিছু হালকা ধরণের তথ্য দিয়েছিল মেজর ক্যালেকে, মনে আছে নিশ্চয়ই। যাই হোক, এই মেসেজ দেখে ল্যাঁদু ভাবল, ‘H21’ কোড পাওয়া মানে হল মাতা হারি নিজেকে জার্মানদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু সন্দেহ দানা বাঁধল এখান থেকে, মাতা হারিকে তো এই অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় নি, সে কেন এই কাজ করতে গেল? এরপরে আরেকটা উদ্ধারকৃত মেসেজে জানা গেল জার্মানরা ‘H21’ এর কাছ থেকে এসব তথ্যের ব্যাপারে আরও কিছু জানতে চেয়েছে। তখন ল্যাঁদু খানিকটা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে মাতা হারি সত্যিই জার্মান স্পাই। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করল না তখনই। তাকে নজরদারিতে রাখা হল যাতে তার পিছু নিয়ে প্যারিসে জার্মান স্পাইদের নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করা যায়।
জানুয়ারির মাঝামাঝি এসে ল্যাঁদু জানতে পারল এমন এক তথ্য যেটা দিয়ে সে চাইলেই বাঁচাতে পারত মাতা হারি কে। জানা গেল, জার্মানরা ব্রিটিশদের হাতে তাদের সাইফার কোড উদ্ধারের ঘটনা জেনে যাওয়ায় পরিকল্পনা করে ‘H21’ কোড দিয়ে মাতা হারির নামে তথ্য বিনিময় করেছে। যাতে এসব তথ্য উদ্ধার করে ফরাসীরা নিজেরাই নিজেদের স্পাইকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মেরে ফেলে।
ল্যাঁদু বুঝতে পারল মাতা হারি নির্দোষ কিন্তু সে এই তথ্যটা দিয়ে তাকে রক্ষা করল না। কে জানে কেন! হয়ত সে ভেবেছিল বিখ্যাত মাতা হারিকে গ্রেফতার করাটাই একটা বড় ধরণের ধাক্কা দেবে হতাশ হয়ে পড়া ফরাসি শিবিরে। যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ে না পেরে যত পারো শুধু স্পাইদের হত্যা কর- এটা দেখালেও সৈন্যদের অন্তত মনে হবে সরকার তাদের জন্য কিছু করছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে স্পাইদের ধরার জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগও হয়ত এর কারণ ছিল।
১৯১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে মাতা হারিকে শত্রুশিবিরের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করা হল। সামরিক প্রসিকিউটর পিয়েরে বুশার্ডনের কাছে মাতা হারি লিখিতভাবে জানাল, “আমি নির্দোষ। কেউ আমাকে ফাঁসাচ্ছে, হয়ত সেটা ফরাসি গোয়েন্দাসংস্থাই। কারণ আমি এর হয়ে কাজ করছি এবং কেবল এর নির্দেশনাই মেনে চলেছি।” মাতা হারিকে গ্রেফতারের খবর গোপন রাখা হল। সে ম্যাসলফ কিংবা কারো সাথেই দেখা করতে পারে নি। নিজের উকিল হিসেবে সে নিয়োগ দিল প্রাক্তন প্রেমিক এডুয়ার্ড ক্লুনেটকে। ৭৪ বছর বয়সী ক্লুনেটের সামরিক আইনের মামলায় অতটা দক্ষতা ছিল না এবং দীর্ঘ চার বছর সে কোনো মামলা লড়ে নি।
mata 1917
গ্রেফতার হবার পর মাতা হারি, ১৯১৭
বুশার্ডন এর কাছে মাতা হারির বিরুদ্ধে তোলার মত খুব গুরুতর কোনো অভিযোগ ছিল না। সে মাতা হারির মাদ্রিদে কিছু তথ্য দেয়ার কথা জানলেও জার্মানদের সাইফার মেসেজের ফাঁদ বানানোর ঘটনাটা জানত না। এর মধ্যে আবার বুশার্ডনের হাতে এল মাতা হারির গ্রহণ করা পাঁচ হাজার ফ্রাঁ এর তথ্য সম্বলিত একটা টাকার রশিদ এবং তাকে জানানো হল ‘গোপন তথ্য’র ভিত্তিতে জানা গেছে এই অর্থ জার্মানরা মাতা হারিকে দিয়েছে। যদিও মাতা হারি টাকাটা গ্রহণ করেছিল সত্যি, কিন্তু সেটা আসলে দিয়েছিল তার প্রেমিক সেই ডাচ ব্যারন।
বুশার্ডন সর্বাত্মক চেষ্টা করতে লাগলে মাতা হারির কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিতে। এদিকে জার্মানরা থেমে নেই তাদের কূটবুদ্ধি প্রয়োগে। তারা আবার মেজর ক্যালের কাছ থেকে মাতা হারির খবর জানতে চাইল যাতে তার বিরুদ্ধে ফরাসিদের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। মাতা হারিকে গ্রেফতারের কথা জার্মানরা জানত, কিন্তু তার এমন ভান করল যেন দুই মাস পরেও তারা সে খবর জানে না এবং ফরাসিরা মনে করে জার্মান স্পাইরা অত্যন্ত দুর্বল।
মাতা হারি বারবার বোঝাতে চাইল সে নির্দোষ, জার্মানরা যুদ্ধের শুরুতেই তার সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়েছে, সে তাদের পক্ষে কাজ করতে পারে না। কিন্তু তার কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দিল ল্যাঁদু। সে বুশার্ডনের কাছে জার্মান সাইফার কোড ভেঙে উদ্ধার করা তথ্যগুলো দিল কিন্তু এটা জানালো না যে এর মধ্যে ফাঁকটা কোথায়। এমনকি সে গোপনে বিচার সম্পন্ন করার পরামর্শ দিল।
prisonযে কারাগারে রাখা হয়েছিল মাতা হারিকে
এদিকে উকিল ক্লুনেট পাঁচ হাজার ফ্রা নেয়ার বিষয়টি পরিস্কার করতে ডাচ ব্যারনের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে চাইল, কিন্তু আদালত তার অনুমতি দিল না। এরপর ক্লুনেট শেষ চেষ্টা করল ল্যাঁদু এবং বুশার্ডনের সাথে মাতা হারির সাক্ষাৎ করিয়ে তাদের বোঝানোর। মাতি হারি তখন জানালো অতীতের এক ঘটনা। ১৯১৬ সালের মে মাসের এক রাতে হঠাৎ তাকে ফোন করেছিল আমস্টারডমের জার্মান দূত ক্রোয়েমার। সে প্রস্তাব দিয়েছিল বিশ হাজার ফ্রাঁ এর বিনিময়ে জার্মানদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে। জার্মানরা তার সব কেড়ে নিয়েছিল তাই যত পারা যায় তাদের টাকা খসানো যাক, এই উদ্দেশ্য নিয়েই মাতা হারি সে টাকা নিয়েছিল। কিন্তু ঐ টাকা নেয়ার পর সে ক্রোয়েমারের সাথে দেখা বা কোনো কিছুই করে নি।
এ ঘটনা থেকে আসলে বোঝা যায় জার্মানদের মাতা হারির উপর এত ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ। তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার তাদেরই বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে আসা মাতা হারিকে যাতে ফরাসিরাই হত্যা করে এজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল জার্মানরা। মাতা হারি স্বীকার করে সে খুব বেপরোয়া কাজ করেছিল, কিন্তু বারবার উচ্চারণ করে একটা কথা, “আমি পেশাদার স্পাই নই, আমি শুধু ভালোবাসা আর আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি।” তবুও মন গলল না ল্যাঁদু আর বুশার্ডনের।
জুলাইয়ের ২৪ তারিখে বিচার বসল। বিচারক আন্দ্রে মর্নেট, একজন যুদ্ধকালীন লেফট্যানেন্ট। তখন যুদ্ধে ফ্রান্সের অবস্থা শোচনীয়। ইতিহাসের অন্যতম বিশাল সংখ্যক সৈন্য মারা পড়েছে তাদের । সাধারণ মানুষ ও সামরিক বাহিনীর লোকজন সকলেই হতাশ। এই অবস্থায় যুদ্ধের এই বিরাট দুর্গতির দায় অন্য কারও কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করল ফরাসি সরকার। সে কাঁধটা হল বিদেশি গুপ্তচরদের। এর মধ্যে পাঁচশ বিদেশিকে গুপ্তচর সন্দেহে আটক করা হয়েছে যাদের মধ্যে তিনশ জনের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত। বিদেশি গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে এই তোড়জোড়ের মাধ্যমে সরকার প্রমাণ করতে চাইছিল যুদ্ধক্ষেত্রের এই দুর্দশার দায় আসলে তাদের নয়, বিদেশি গুপ্তচরদের দুর্ধর্ষতার কারণেই এই পরিণতি হয়েছে।
mata-hari-trialবিচার চলছে মাতা হারির
বিচারক মর্নেট আদালতে জানালো মাতা হারির উপরে নাকি দীর্ঘদিন কড়া নজরদারি রেখে জানা গেছে সে ফরাসি সামরিক অফিসারদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে তথ্য জোগাড় করত। তার ম্যাসলফের সাথে প্রেম, ব্রিটেনে গ্রেফতার হওয়া, H21 কোড পাওয়া ইত্যাদি সব খুঁটিনাটি বলে গেল মর্নেট। সে বলল, এই নারী পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম নারীদের একজন। সে অনেক ভাষা জানে, তার সুক্ষ অভিনয়, তার ঋজু চলন, বুদ্ধি, ধুরন্ধরতা এসব তার গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহার করেছে। মর্নেট প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করল বার্লিনের সেই পুলিশ অফিসার জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্তাব্যক্তি এবং তার সাথে মাতা হারির সত্যিকারের প্রেমের সম্পর্ক আছে। সে বলল, “এই নারী কী পরিমাণ শয়তান তা অবিশ্বাস্য! সে সম্ভবত এই শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ নারী গুপ্তচর।”
মাতা হারির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেওয়া হল না। তার যুদ্ধরত এক পুরনো বন্ধু জেনারেল এডলফ পিয়েরে ম্যাসিমি লিখে পাঠিয়েছিল যে তার সাথে মাতা হারি কখনো যুদ্ধ নিয়ে কথা বলে নি। আরেক বন্ধু সেই মার্গুয়েরি তার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চাইলেও আদালত সুযোগ দেয় নি। মাত্র ৪০ মিনিটেই সাক্ষ্য-প্রমাণবিহীন এই বিচার সম্পন্ন করে আটটি অভিযোগে ১৯১৫ ও ১৯১৭ সালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে মাতা হারিকে দায়ী সাব্যস্ত করা হয়।
মাতা হারি তার গুপ্তচরবৃত্তির জীবনে মাত্র তিনটি বিকেল বেলা সময় দিয়েছিল। মেজর ক্যালের কাছ থেকে কিছু ভুয়া তথ্য পাওয়া আর তাকে কিছু সাধারণ তথ্য দেওয়া ছাড়া সে আর কিছুই করে নি। জার্মানদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কোনো তথ্য তাদের সে দেয় নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান গুপ্তচরদের তালিকা ও তাদের স্মরণিকা খুজলে কোথাও মাতা হারির নাম পাওয়া যায় নি। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাকে হত্যার সুক্ষ পরিকল্পনা সফল হল।
১৫ অক্টোবর, ১৯১৭, সকাল বেলা। মাতা হারি তৈরি হল শেষ যাত্রার জন্য। তিনটি চিঠি লিখল সে। তার মেয়ে, ম্যাসলফ আর মার্গুয়েরির কাছে। জেল থেকে গাড়িতে তাকে নিয়ে যাওয়া হল ভিনসেন্স এর বড় মাঠটিতে। ১২ জন সৈন্যের একটি দল অস্ত্র নিয়ে তৈরি। মাতা হারি তার গায়ের কোটটা খুলে সাথে আসা নারী যাজকটিকে দিল। একজন অফিসার এল হাত ধরে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। মাতা হারি তার হাত ছাড়িয়ে একাই হেঁটে গেল গুলি করা হবে যে জায়গাটায় সেখানের দিকে। যেতে যেতে সে দেখছিল ১২ জন সৈন্যকে। সেখানে পৌঁছানোর পর একজন ক্যাপ্টেন তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পড়ে শোনাল। একজন অফিসার এল তার হাত পিছনে বেঁধে দিতে। “তার দরকার হবে না”, বলল মাতা হারি। এরপর তার চোখে কালো কাপড় পরিয়ে দিতে চাইলে সেটাও নিষেধ করল। অফিসারটি অনুচ্চ স্বরে তার পাশে থাকা সৈন্যদলের অধিনায়ককে বল, “এই নারী জানে কীভাবে মরতে হয়।” অধিনায়ক হাত উঠিয়ে প্রস্তুত হতে বলল সৈন্যদের। মাতা হারি তাকালো সামনের দিকে। স্পষ্ট স্বরে বল, “থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।” মৃদু হাসি দিয়ে এরপর হাতটা ঠোঁটে আলতো করে ছুঁয়ে একটা উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দিল ফায়ারিং স্কোয়াডের অস্ত্র তাক করে রাখা সৈন্যদের দিকে। অধিনায়ক হাত নামিয়ে গুলির আদেশ দিল। গুলি হল ১১ টি। কারণ একজন সৈন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল।
mata-hari-executionচলচ্চিত্রের দৃশ্যে মাতা হারির মৃত্যুদণ্ড চিত্রায়ণ
সিনেমার দৃশ্যের মত মাতা হারি আঁতকে উঠল না। ধীরে ধীরে তার পা দুটো ভাজ হয়ে গেল। তখনও মাথাটা উঁচু করা। এরপর সে ঢলে পড়ল পেছনের দিকে। একজন সৈন্য এগিয়ে এসে রিভলবার বের করে গুলি করল তার মাথায়, মাতা হারি নিশ্চিত ভাবেই এবার বিদায় নিল অজানার উদ্দেশ্যে।
bell1917মাতা হারির মৃত্যুদণ্ডের দিন সন্ধ্যায় এই ঘণ্টা বাজানো হয়
এভাবেই নির্মিত হল ইতিহাসের এক ট্র্যাজেডি নাটক। এই পৃথিবীতে মানুষ ইতিহাসের অনেক নারী কিংবা পুরুষকে বীর আখ্যা দিয়েছে, স্মরণ করেছে তাঁদের কীর্তির জন্য। কিন্তু মাতা হারির নামকে কোথাও বীর হিসেবে সম্মানিত করা হয় নি। কিন্তু মানুষের ইতিহাসে লেখা না থাকলেও পৃথিবী জানে, একটি সৈন্যের মৃত্যুর জন্যও সে দায়ী ছিল না, মাতা হারি বিশ্বাসঘাতক ছিল না, হৃদয়ের মানবতাকে সে হত্যা করে নি। মাতা হারি মিথ্যা অভিযোগে দুর্ধর্ষ স্পাই তালিকার শীর্ষে আসতে চায় নি, সে স্বপ্ন দেখেছিল সুখের সংসারের, সে বাঁচতে চেয়েছিল ভালোবাসা আর আনন্দ নিয়ে।



বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭


পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ১০টি শহরের কথা

দেড় কোটি মানুষের আবাসস্থল আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলো। প্রতি সকালে হাজারো মানুষের প্রাণ চাঞ্চল্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে ঢাকার অলিগলি। একবারও ভেবে দেখেছেন কী দেড়শ বছর আগে কেমন ছিল এই শহর? কেমন ছিল এই শহরের মানুষগুলো? ঢাকার গোড়াপত্তন আজ থেকে প্রায় চারশ বছর আগে। তবে এই পৃথিবীতে এমন অনেক শহর রয়েছে যেগুলো গড়ে উঠেছিল আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। তবে সেই প্রাচীন নগরগুলোর বেশির ভাগই এখন মৃত। তবুও কালের পরিক্রমায় আজও কিছু শহর বেঁচে আছে, বেঁচে আছে কয়েক হাজারের বিচিত্র স্মৃতি বুকে নিয়ে। সেই যে কে বা কারা সহস্র বছর আগে সেখানে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়েছিল তা নেভেনি আজও। এরকম দশটি পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত শহর আমাদের আজকের এই আয়োজন।
১০) বৈরুত- লেবনন
বৈরুত লেবাননের রাজধানী এবং দেশের বৃহত্তম শহর। এই শহরের সাথে জড়িয়ে আছে কমপক্ষে ৫০০০ বছরের ইতিহাস। ফিনিশীয়, গ্রীক হেলেনিয়, রোমান, আরব, ওসমানীয় আমলের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছে বৈরুত। প্রায় ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফেরাউনের চিঠিতে উল্লেখ্য পাওয়া যায় এই শহরের নাম। বর্তমানে প্রায় ২২ লক্ষ লোকের বাস ভূমধ্যসাগরের পাড়ে অবস্থিত এই শহরে। ১৯৯০ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে দ্রুত উন্নতি করে চলেছে বৈরুত। ২০১৫ সালে বৈরুতকে সাতটি New 7 Wonders Cities এর একটি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অট্টালিকা শোভিত আধুনিক বৈরুতে গেলে আপনি হয়ত বুঝতেই পারবেন না এর প্রাচীনত্বঅট্টালিকা শোভিত আধুনিক বৈরুতে গেলে আপনি হয়ত বুঝতেই পারবেন না এর প্রাচীনত্ব।


০৯) গাজিয়ানটেপ-তুরস্ক
তুরস্কের দক্ষিণে আনাতোলিয়া অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর। বর্তমানে গাজিয়ানটেপ শহরে প্রায় ১৫ লক্ষ অধিবাসী বাস করে। সিরিয়ার আলেপ্পো শহর থেকে মাত্র ৯৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহরটি ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যুগে যুগে।
রাতের বেলায় সুসজ্জিত গাজিয়ানটেপ www.middleastfreezone.comরাতের বেলায় সুসজ্জিত গাজিয়ানটেপ

০৮) প্লভদিভ-বুলগেরিয়া
প্লভদিভ বুলগেরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। বর্তমান জনসংখ্যা ৫ লক্ষের মত। নিওলিথিক যুগ থেকেই এই শহরে মনুষ্য বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। তবে ধারণা করা হয় বিগত ৪০০০ বছর ধরে এখনও জীবিত আছে প্লভদিভ। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে পারসিয়ান সম্রাট দারিয়ুস দ্যা গ্রেট প্লভদিভ জয় করেন। এরপর বিভিন্ন সময় গ্রীক, রোমান, গথ, স্লাভ ও বাইজান্টাইন, ওসমানীয়দের অধীনে ছিল এই শহর।

সাজানো গোছানো প্লভদিভ শহরসাজানো গোছানো প্লভদিভ শহর


০৭) সিডন-লেবানন
লেবাননের তৃতীয় বৃহত্তম শহর সিডন। ফিনিশিয় সভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ এই শহর রাজধানী লেবননের মাত্র ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিডন জয় করেন। বলা হয়ে থাকে যিশুখ্রিস্ট এবং সেইন্ট পল নাকি এই শহরে এসেছিলেন। বর্তমানে সিডনের জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ।
সিডন শহরের এই অংশে ইতিহাস মিশেছে বর্তমানের সাথেসিডন শহরের এই অংশে ইতিহাস মিশেছে বর্তমানের সাথে

০৬) আল ফায়ুম-মিশর
আল ফায়ুম আফ্রিকা এবং মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি। গ্রিকদের কাছে আল ফায়ুম পরিচিত ছিল কুমিরের শহর হিসাবে। আজ থেকে প্রায় ৬০০০ বছর আগে গোড়াপত্তন ঘটে এই শহরের। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে যুগে যুগে ফায়ুমের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই বর্তমানে এর আয়তন বেশ ছোট তবে শহরের বাইরে পিরামিডসহ বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক মসজিদ বিদ্যমান।

ফায়ুম থেকে পাওয়া মমির সাথে কাঠে আঁকা চিত্র

ফায়ুম থেকে পাওয়া মমির সাথে কাঠে আঁকা চিত্র

০৫) শুশ- ইরান
শুশ পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি। হিব্রু বাইবেলেও উল্লেখ্য পাওয়া যায় এর নাম। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে শুশ শহরের বয়স অন্তত সাড়ে ৬ হাজার বছর। বর্তমানে প্রায় এক লক্ষ লোকের বাস এই শহরে। মেসোপটেমিও এবং পারস্য সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ এই শহর ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত।
প্রাচীন শুশ নগরী আপনাকে নিয়ে যাবে সুদূর অতীতেপ্রাচীন শুশ নগরী আপনাকে নিয়ে যাবে সুদূর অতীতে

০৪) দামেস্ক-সিরিয়া
সভ্যতার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হবে কিন্তু সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নাম উঠে আসবে না এটা কল্পনা করাও দুরূহ ব্যাপার। প্রায় দশ হাজার বছর ধরে মানুষের বসতির চিহ্ন মেলে এখানে। তাই অনেকেই দাবি করেন দামেস্কই পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর। তবে এখনও সেই দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ মেলেনি। সেই আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, পম্পেই থেকে শুরু করে খালেদ ইবনে ওয়ালিদের মত অসাধারণ সব বিজেতার পদধূলিতে যুগ যুগ ধরে ধন্য দামেস্কের মাটি।
দামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়া মসজিদদামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়া মসজিদ

০৩) আলেপ্পো-সিরিয়া
আরবিতে হালব নামেই পরিচিত এই শহর। গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে সিরিয়ার বৃহত্তম শহর ছিল আলেপ্পো। ইতিহাসে দামেস্কের সাথে আলেপ্পোর নাম যেন আপনা আপনিই চলে আসে। সেই প্রাচীনকালে হিট্টি, অ্যাসেরিয়, পারসিয়ান থেকে শুরু করে মধ্যযুগে ক্রুসেডসহ অসংখ্য সভ্যতার স্মৃতিবিজড়িত আলেপ্পো। যুগে যুগে ধ্বংস স্তূপ থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বারবার। মঙ্গোলরা আলেপ্পো ধ্বংস করেছে, আলেপ্পো ধ্বংস হয়েছে ক্রুসেডের সময় বারবার। তবু আজও বেঁচে আছে আলেপ্পো। বেঁচে আছে অতীতের গর্বিত ইতিহাস নিয়ে। তবে চলমান গৃহযুদ্ধে মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সিরিয়ার উত্তরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক শহরটি। সকল ইতিহাসপ্রেমী মানুষরই এখন প্রত্যাশা হয়ত গৃহযুদ্ধ শেষে কোন একদিন আবারও আগের মতই প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর হয়ে উঠবে ৬০০০ বছরের পুরনো আলেপ্পো।
গৃহযুদ্ধের আগে ও পরে আলেপ্পোর উমাইয়া মসজিদ www.theguardian.comগৃহযুদ্ধের আগে ও পরে আলেপ্পোর উমাইয়া মসজিদ

০২) বাইব্লস- লেবানন
ফিনিশিও সভ্যতার আরও একটি নিদর্শন বাইব্লস শহর। আরবী নাম জুবাইল। পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীন এই নগরের ইতিহাস প্রায় ৭০০০ বছরের পুরনো। গ্রিকরা বাইব্লোস থেকে প্যাপিরাস আমদানি করত। বাইব্লোস নামটি তাদেরই দেওয়া। রাজধানী বৈরুত থেকে ৪২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত জুবাইল শহরের জনসংখ্যা এখন প্রায় এক লাখ। শহরটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত।
মিশরীয় দেবী আইসিসের অনেক পৌরাণিক আছে বাইব্লসকে ঘিরেমিশরীয় দেবী আইসিসের অনেক পৌরাণিক কাহিনী আছে বাইব্লসকে ঘিরে

০১) জেরিকো- ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনের অন্তর্ভুক্ত জেরিকো নগরীকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত নগরী। জেরিকোর সাথে জড়িয়ে আছে প্রায় ১১০০০ বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাস। আরবিতে জেরিকোর নাম আরিয়াহ বা সুবাস। পৃথিবীর প্রাচীনতম নগর জেরিকোতে বর্তমান লোকসংখ্যা মাত্র ২৫ হাজার।
jericho-01জেরিকোতে প্রাণের সপ্নদন
একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন মানব সভ্যতার প্রাচীনতম শহরগুলোর অবস্থান কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং তার আসে পাশে। নব্যপ্রস্তর যুগে কৃষিকাজ আয়ত্ত্ব করার পর পরই নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে শুরু করেছিল। সেই সময়ে গড়ে ওঠা কিছু শহর আজও বেঁচে আছে অতীতের সাক্ষী হয়ে। জানান দিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতার ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবার ইতিহাস। হয়ত এই শহরগুলোর রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া মানুষগুলো কান পাতলে আজও শোনে হাজার হাজার বছরের পুরনো সেই কাহিনী!