বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭


প্রাচীন পৃথিবীর দুর্গ রহস্য

যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস নিয়ে আমাদের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। আর বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটালেই দেখা যাবে যে, যুদ্ধে সৈন্য সংখ্যা কিংবা গোলাবারুদ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো রণকৌশল। অনেক সময়ই দেখা গেছে, সৈন্য কিংবা অস্ত্রের আধিক্য না থাকলেও শুধু কিছু কৌশল অবলম্বন করার কারণেই সংখ্যালঘু পক্ষ জিতে গেছে সেই যুদ্ধে।
আগেকার দিনের যুদ্ধগুলোর এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো বিভিন্ন দুর্গ। এসব দুর্গে যুদ্ধের ভয়াবহতা কোন মাত্রায় পৌঁছতে পারে তার চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায় যুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত নানা বইয়ে। সেই সাথে বিভিন্ন সিনেমা কিংবা ডকুমেন্টরি দেখেও এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা লাভ করা সম্ভব। আগেকার দিনে তলোয়ারের ঝনঝনানিতে মুখর নানা দুর্গের কিছু গোপন রহস্য নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের লেখা।

পরিখা

পরিখাপরিখা
দুর্গের কথা চিন্তা করলে প্রথমেই আমাদের মাথায় ভেসে ওঠে এর চারদিক ঘিরে থাকা এক জলাশয়ের প্রতিচ্ছবি। আসলে যুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক নানা সিনেমা দেখতে দেখতেই আমরা এমন জিনিস কল্পনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।
পরিখা খননের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে অনেকেই বলবে- “শত্রুপক্ষ যাতে সহজে দুর্গের কাছে যেতে না পারে, সেজন্য তাদের যাত্রাপথে বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে এসব পরিখা খনন করা হয়।” কথাটি আংশিক ঠিক, তবে পুরোপুরি নয়। কারণ শত্রুপক্ষের যাত্রাপথে বাঁধা সৃষ্টি করা পরিখা খননের একটি উদ্দেশ্য হলেও সেটি এর মূল কাজ না। দুর্গের ভেতরে থাকা মানুষগুলোর এক বড় আতঙ্কের নাম ছিলো সুড়ঙ্গ। শত্রুপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাদেরকে এ ভয়ে থাকা লাগতো যে, শত্রু হয়তো তাদের দুর্গের চারদিকে সুড়ঙ্গ খনন করতে পারে। যদি একবার ঠিকমতো সেই সুড়ঙ্গ আসলেই তৈরি করা যেতো, তাহলে সেই সুড়ঙ্গের পথ ধরে আক্রমণকারী বাহিনীর পক্ষে দুর্গের একেবারে ভেতরে চলে আসা অসম্ভব ছিলো না। আর সেই সাথে এমন সুড়ঙ্গের সাহায্যে দুর্গের দেয়ালেরও ভালোই ক্ষতি করা যেতো।
অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন কিংবা দেয়ালের ক্ষতি- এ দুইয়ের হাত থেকে বাঁচতেই মূলত দুর্গের চারদিকে পরিখা খনন করা হতো। আর এটা যে আসলেই কাজে দিতো, সেটা তো না বললেও চলে। অধিকাংশ সময় পরিখা দুর্গের বাহিরেও খনন করা হতো না। বরং সেটা দুর্গের বাহিরের দেয়াল ও ভেতরের দেয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে তৈরি করা হতো।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

castle-2

দুর্গের অধিবাসীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নেয়া হতো কঠোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। দুর্গের বাহির থেকে ভেতর পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে সাজানো হতো প্রতিরক্ষার নানা স্তর। এতে করে শত্রুপক্ষকে অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন করানো যেতো। এর শুরু হতো বাইরের খোলা প্রান্তর দিয়ে। তারপর ক্রমান্বয়ে বাইরের দেয়াল, পরিখা, ভেতরের দেয়াল, কীপ (এক ধরণের বৃহদাকার সুরক্ষিত টাওয়ার) ও স্ট্রংহোল্ড টাওয়ারের উপস্থিতি আক্রমণকারীদের পক্ষে দুর্গের ভেতরে ঢোকাকে আরো কঠিন করে তুলতো। আক্রমণকারী বাহিনীকে এ বাঁধাগুলোর সবগুলো অতিক্রম করে তবেই ঢুকতে হতো দুর্গের ভেতরে। ফলে সময় এবং শক্তি এ দুয়েরই মারাত্মক ক্ষয় হতো তাদের।

towerটাওয়ার

প্রধান ফটকের মৃত্যুকূপ

castle-3

একটি দুর্গের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকা যে কতটা কঠিন তা আমরা বিভিন্ন সময়ই রুপালি পর্দায় দেখেছি কিংবা ইতিহাস বিষয়ক বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে পড়েছি। আমাদের কল্পনায় থাকা যুদ্ধরত সৈন্যকেও যে তখন মারাত্মক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে, তা বোধহয় না বললেও চলে। তবে অধিকাংশ সময় এ প্রধান ফটক কাজ করতো এক মৃত্যুকূপের প্রবেশ পথ হিসেবে। কারণ প্রধান ফটক পেরোলে আক্রমণকারী বাহিনী প্রবেশ করতো প্রাচীরঘেরা এক উঠানে। এজন্য আগে থেকে ফটকের সাথে থাকা লোহার গরাদটি খোলা রাখা হতো। যেই না আক্রমণকারী বাহিনী প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতো, অমনি কিছুক্ষণের মাঝে লোহার গরাদটি বন্ধ করে দেয়া হতো। ফলে দুর্গে আক্রমণকারীরা তখন ছোটখাট এক উঠানের ফাঁদে আটকা পড়ে যেতো। এ উঠানের চারদিকে থাকা প্রাচীরে অনেকগুলো ছোট ছোট গর্ত থাকতো যেগুলোকে বলা হতো মৃত্যুরন্ধ্র। এসব রন্ধ্র দিয়ে দুর্গে থাকা সেনারা আক্রমণকারীদের দিকে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করতো। ফলে তাৎক্ষণিক চাতুর্যের পরিচয় দিতে না পারলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দলে দলে মারা পড়তে হতো আক্রমণকারীদের।

সিঁড়ির রহস্য

সিঁড়িসিঁড়ি
একটি দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা বুদ্ধি খাটিয়ে সাজানো যেতে পারে, তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ এর সিঁড়িগুলো। তখনকার সময়ে সিঁড়িগুলো বানানো হতো খুবই সরু করে। আর সেগুলো নিচে থেকে উপরে ওঠার ডিজাইন হতো ঘড়ির কাটার দিক বরাবর। সামান্য এ ডিজাইনেও অনেক সুবিধা পেতো আক্রান্ত দুর্গবাসীরা।
আমাদের আশেপাশে দেখা অধিকাংশ মানুষই ডানহাতি। সেটা এখনকার জন্য যেমন সত্য, তেমনই সত্য ছিলো শত শত বছর আগেকার ইতিহাসেও। একজন আক্রমণকারী সৈনিক যখন নিচ থেকে উপরের দিকে উঠবে, তখন তার ডান হাতেই থাকবে তলোয়ারটি (অধিকাংশ ক্ষেত্রে)। কিন্তু সিঁড়িটি ঘড়ির দিক বরাবর ডিজাইন করে বানানোয় তার তলোয়ার ধরা হাত থাকবে দেয়ালের পাশে। ফলে তলোয়ারটি ইচ্ছেমতো চালাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হতো। অন্যদিকে উপর থেকে নিচের দিকে নামা দুর্গের সৈনিককে কিন্তু এমন সমস্যায় পড়তে হতো না। কারণ সে ডানহাতি হলেও তলোয়ার ধরা হাতের পাশে থাকতো না কোনো দেয়াল। ফলে আক্রমণকারী সৈন্যের চেয়ে শুরুতেই এগিয়ে যেতো সে।
শুধু উপরের ডিজাইনটিই না, পাশাপাশি আরেকটি ডিজাইনও সিঁড়িগুলোকে আক্রমণকারীদের জন্য এক বড় প্রতিবন্ধকতা বানিয়ে রেখেছিলো। আমাদের বাড়ি-ঘরের সিঁড়ির ধাপগুলো সাধারণত একই উচ্চতার রাখা হয়। এতে করে আমাদের চলাচলে সুবিধা হয়। যদি উচ্চতা সমান না হতো, তাহলে অবধারিতভাবেই ওঠানামা করতে গিয়ে আমাদের হাত-পা ভাঙা লাগতো। আর এ কৌশলটিই কাজে লাগানো হয়েছিলো দুর্গের সিঁড়ি বানানোর সময়। কোনো ধাপ হতো বেশি উঁচু, কোনোটি আবার বেশি নিচু। যারা দুর্গের বাসিন্দা, তারা তো এমন অসমান গঠনের সিঁড়ির সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। ফলে সেগুলো দিয়ে ওঠানামা করতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হতো না। তবে ঝামেলায় পড়তো আক্রমণকারীরা। সিঁড়ির এমন বৈচিত্র্য সম্পর্কে কোনো পূর্বজ্ঞান থাকতো না তাদের। পাশাপাশি সেখানে আলো কম থাকায় আরো ঝামেলায় পড়তো তারা।
সব মিলিয়ে এ সিড়িই আক্রমণকারী বাহিনীর চোখে এমনভাবে সর্ষে ফুল দেখাতো যে তাদের তখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হয়ে যেতো।

গোপন সুড়ঙ্গ

গোপন সুড়ঙ্গগোপন সুড়ঙ্গ
একটি দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য এতসব ব্যবস্থা নেয়া হবে, অথচ সেখানকার অধিবাসীদের ব্যবহারের জন্য কোনো গোপন সুড়ঙ্গ থাকবে না সেটা কী করে হয়? আগেকার দিনের অধিকাংশ দুর্গেই এর অধিবাসীদের জন্য রাখা হতো বিভিন্ন গোপন সুড়ঙ্গ। এসব সুড়ঙ্গ বানানোর পেছনে বিভিন্ন রকম উদ্দেশ্য কাজ করতো।
কোনো কোনো সুড়ঙ্গ শেষ হতো দুর্গ থেকে বেশ কিছু দূরে, যাতে করে শত্রুর আক্রমণের মুখে দুর্গের অধিবাসীরা নিরাপদে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারে। শত্রুদের দ্বারা অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় বিভিন্ন খাদ্য ও যুদ্ধ সামগ্রীও এসব সুড়ঙ্গ পথেই আনা-নেয়া করা হতো। এছাড়া কোনো কোনো সুড়ঙ্গ গিয়ে শেষ হতো কোনো গোপন কুঠুরিতে যেখানে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারতো, রসদ লুকিয়ে রাখা যেতো কিংবা খুঁড়ে রাখা হতো পানির কূপ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন