পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ১০টি শহরের কথা
দেড় কোটি মানুষের আবাসস্থল আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলো। প্রতি সকালে হাজারো মানুষের প্রাণ চাঞ্চল্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে ঢাকার অলিগলি। একবারও ভেবে দেখেছেন কী দেড়শ বছর আগে কেমন ছিল এই শহর? কেমন ছিল এই শহরের মানুষগুলো? ঢাকার গোড়াপত্তন আজ থেকে প্রায় চারশ বছর আগে। তবে এই পৃথিবীতে এমন অনেক শহর রয়েছে যেগুলো গড়ে উঠেছিল আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। তবে সেই প্রাচীন নগরগুলোর বেশির ভাগই এখন মৃত। তবুও কালের পরিক্রমায় আজও কিছু শহর বেঁচে আছে, বেঁচে আছে কয়েক হাজারের বিচিত্র স্মৃতি বুকে নিয়ে। সেই যে কে বা কারা সহস্র বছর আগে সেখানে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়েছিল তা নেভেনি আজও। এরকম দশটি পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত শহর আমাদের আজকের এই আয়োজন।
১০) বৈরুত- লেবনন
বৈরুত লেবাননের রাজধানী এবং দেশের বৃহত্তম শহর। এই শহরের সাথে জড়িয়ে আছে কমপক্ষে ৫০০০ বছরের ইতিহাস। ফিনিশীয়, গ্রীক হেলেনিয়, রোমান, আরব, ওসমানীয় আমলের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছে বৈরুত। প্রায় ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফেরাউনের চিঠিতে উল্লেখ্য পাওয়া যায় এই শহরের নাম। বর্তমানে প্রায় ২২ লক্ষ লোকের বাস ভূমধ্যসাগরের পাড়ে অবস্থিত এই শহরে। ১৯৯০ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে দ্রুত উন্নতি করে চলেছে বৈরুত। ২০১৫ সালে বৈরুতকে সাতটি New 7 Wonders Cities এর একটি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অট্টালিকা শোভিত আধুনিক বৈরুতে গেলে আপনি হয়ত বুঝতেই পারবেন না এর প্রাচীনত্ব।
০৯) গাজিয়ানটেপ-তুরস্ক
তুরস্কের দক্ষিণে আনাতোলিয়া অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর। বর্তমানে গাজিয়ানটেপ শহরে প্রায় ১৫ লক্ষ অধিবাসী বাস করে। সিরিয়ার আলেপ্পো শহর থেকে মাত্র ৯৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহরটি ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যুগে যুগে।
রাতের বেলায় সুসজ্জিত গাজিয়ানটেপ
০৮) প্লভদিভ-বুলগেরিয়া
প্লভদিভ বুলগেরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। বর্তমান জনসংখ্যা ৫ লক্ষের মত। নিওলিথিক যুগ থেকেই এই শহরে মনুষ্য বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। তবে ধারণা করা হয় বিগত ৪০০০ বছর ধরে এখনও জীবিত আছে প্লভদিভ। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে পারসিয়ান সম্রাট দারিয়ুস দ্যা গ্রেট প্লভদিভ জয় করেন। এরপর বিভিন্ন সময় গ্রীক, রোমান, গথ, স্লাভ ও বাইজান্টাইন, ওসমানীয়দের অধীনে ছিল এই শহর।
সাজানো গোছানো প্লভদিভ শহর
০৭) সিডন-লেবানন
লেবাননের তৃতীয় বৃহত্তম শহর সিডন। ফিনিশিয় সভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ এই শহর রাজধানী লেবননের মাত্র ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিডন জয় করেন। বলা হয়ে থাকে যিশুখ্রিস্ট এবং সেইন্ট পল নাকি এই শহরে এসেছিলেন। বর্তমানে সিডনের জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ।
সিডন শহরের এই অংশে ইতিহাস মিশেছে বর্তমানের সাথে
০৬) আল ফায়ুম-মিশর
আল ফায়ুম আফ্রিকা এবং মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি। গ্রিকদের কাছে আল ফায়ুম পরিচিত ছিল কুমিরের শহর হিসাবে। আজ থেকে প্রায় ৬০০০ বছর আগে গোড়াপত্তন ঘটে এই শহরের। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে যুগে যুগে ফায়ুমের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই বর্তমানে এর আয়তন বেশ ছোট তবে শহরের বাইরে পিরামিডসহ বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক মসজিদ বিদ্যমান।
ফায়ুম থেকে পাওয়া মমির সাথে কাঠে আঁকা চিত্র
০৫) শুশ- ইরান
শুশ পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি। হিব্রু বাইবেলেও উল্লেখ্য পাওয়া যায় এর নাম। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে শুশ শহরের বয়স অন্তত সাড়ে ৬ হাজার বছর। বর্তমানে প্রায় এক লক্ষ লোকের বাস এই শহরে। মেসোপটেমিও এবং পারস্য সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ এই শহর ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত।
প্রাচীন শুশ নগরী আপনাকে নিয়ে যাবে সুদূর অতীতে
০৪) দামেস্ক-সিরিয়া
সভ্যতার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হবে কিন্তু সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নাম উঠে আসবে না এটা কল্পনা করাও দুরূহ ব্যাপার। প্রায় দশ হাজার বছর ধরে মানুষের বসতির চিহ্ন মেলে এখানে। তাই অনেকেই দাবি করেন দামেস্কই পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর। তবে এখনও সেই দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ মেলেনি। সেই আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, পম্পেই থেকে শুরু করে খালেদ ইবনে ওয়ালিদের মত অসাধারণ সব বিজেতার পদধূলিতে যুগ যুগ ধরে ধন্য দামেস্কের মাটি।
দামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়া মসজিদ
০৩) আলেপ্পো-সিরিয়া
আরবিতে হালব নামেই পরিচিত এই শহর। গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে সিরিয়ার বৃহত্তম শহর ছিল আলেপ্পো। ইতিহাসে দামেস্কের সাথে আলেপ্পোর নাম যেন আপনা আপনিই চলে আসে। সেই প্রাচীনকালে হিট্টি, অ্যাসেরিয়, পারসিয়ান থেকে শুরু করে মধ্যযুগে ক্রুসেডসহ অসংখ্য সভ্যতার স্মৃতিবিজড়িত আলেপ্পো। যুগে যুগে ধ্বংস স্তূপ থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বারবার। মঙ্গোলরা আলেপ্পো ধ্বংস করেছে, আলেপ্পো ধ্বংস হয়েছে ক্রুসেডের সময় বারবার। তবু আজও বেঁচে আছে আলেপ্পো। বেঁচে আছে অতীতের গর্বিত ইতিহাস নিয়ে। তবে চলমান গৃহযুদ্ধে মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সিরিয়ার উত্তরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক শহরটি। সকল ইতিহাসপ্রেমী মানুষরই এখন প্রত্যাশা হয়ত গৃহযুদ্ধ শেষে কোন একদিন আবারও আগের মতই প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর হয়ে উঠবে ৬০০০ বছরের পুরনো আলেপ্পো।
গৃহযুদ্ধের আগে ও পরে আলেপ্পোর উমাইয়া মসজিদ
০২) বাইব্লস- লেবানন
ফিনিশিও সভ্যতার আরও একটি নিদর্শন বাইব্লস শহর। আরবী নাম জুবাইল। পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীন এই নগরের ইতিহাস প্রায় ৭০০০ বছরের পুরনো। গ্রিকরা বাইব্লোস থেকে প্যাপিরাস আমদানি করত। বাইব্লোস নামটি তাদেরই দেওয়া। রাজধানী বৈরুত থেকে ৪২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত জুবাইল শহরের জনসংখ্যা এখন প্রায় এক লাখ। শহরটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত।
মিশরীয় দেবী আইসিসের অনেক পৌরাণিক কাহিনী আছে বাইব্লসকে ঘিরে
০১) জেরিকো- ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনের অন্তর্ভুক্ত জেরিকো নগরীকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত নগরী। জেরিকোর সাথে জড়িয়ে আছে প্রায় ১১০০০ বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাস। আরবিতে জেরিকোর নাম আরিয়াহ বা সুবাস। পৃথিবীর প্রাচীনতম নগর জেরিকোতে বর্তমান লোকসংখ্যা মাত্র ২৫ হাজার।
জেরিকোতে প্রাণের সপ্নদন
একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন মানব সভ্যতার প্রাচীনতম শহরগুলোর অবস্থান কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং তার আসে পাশে। নব্যপ্রস্তর যুগে কৃষিকাজ আয়ত্ত্ব করার পর পরই নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে শুরু করেছিল। সেই সময়ে গড়ে ওঠা কিছু শহর আজও বেঁচে আছে অতীতের সাক্ষী হয়ে। জানান দিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতার ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবার ইতিহাস। হয়ত এই শহরগুলোর রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া মানুষগুলো কান পাতলে আজও শোনে হাজার হাজার বছরের পুরনো সেই কাহিনী!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন