সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭


শিং ও মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি

শিং ও মাগুর মাছের পরিচিতি
শিং ও মাগুর মাছের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কিছুটা মিল রয়েছে। এদের দেহ লম্বাটে, সামনের দিক নলাকার, পিছনের দিক চ্যাপ্টা ও আঁশ বিহীন এবং মাথার উপর নিচ চ্যাপ্টা। মুখে চার জোড়া শুড় ও মাথার দুই পাশে দুটি কাঁটা আছে। কিন্তু শিং মাছ মাগুর মাছের চেয়ে আকারে ছোট হয় এবং মাথা তুলনামূলক সরু হয়। শিং মাছের পার্শ্বিয় কাটা দুটো বিষাক্ত হয়। এজন্য শিং মাছের কাঁটা খেলে আক্রান্ত স্থানে যথেষ্ট ব্যথা অনুভব হয়। শিং মাছের দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামি লাল এবং বড় অবস্থায় ধূসর কালচে। অন্যদিকে মাগুরের দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামি খয়েরি ও বড় হলে ধূসর বাদামি হয়। শিং ও মাগুর মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ফুলকা ছাড়াও এদের অতিরিক্ত শ্বসনতন্ত্র আছে যার মাধ্যমে এরা বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন নিতে পারে। ফলে এরা অল্প অক্সিজেন যুক্ত পানিতে বা পানি ছাড়াও দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। এজন্য শিং ও মাগুর মাছকে জিওল মাছ বলা হয়। শিং ও মাগুর মাছ সর্বভুক জাতীয় মাছ। এরা জলাশয়ের তলদেশে থাকে এবং সেখানকার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী ও পচা জৈব আবর্জনা খায়। এরা বছরে ১ বার প্রজনন করে থাকে। এদের প্রজনন কাল হচ্ছে মে থেকে সেপ্টেম্বর | তবে জুন-জুলাই মাসে এদের সর্বোচ্চ প্রজনন হয়ে থাকে।


শিং ও মাগুর চাষের সুবিধা

১. বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে তাই এ মাছ চাষে অধিক মুনাফা লাভ করা যায়।

২. চাষ পদ্ধতি সহজ। যে কোনো ধরনের জলাশয়ে এমনকি চৌবাচ্চা ও খাঁচাতেও চাষ করা যায়।

৩. প্রতিকূল পরিবেশে যেমন-অক্সিজেন স্বল্পতা, পানির অত্যাধিক তাপমাত্রা , এমনকি পচা পানিতেও এরা বেঁচে থাকে।
৪. অল্প পানিতে ও অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়।
৫. রোগবালাই খুব কম হয় ও অধিক সহনশীল।
৬. অল্প পানিতে এমনকি পানি ছাড়াও এরা দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকে বলে জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করা যায়।
৭. সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে অল্প সময়েই (৬-৮ মাস) বাজারজাত করার উপযোগী হয়।
৮. একক মাছ চাষ ছাড়াও অন্যান্য কার্প মাছ, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছের সাথে পুকুরে মিশ্র চাষ করা যায়।

শিং ও মাগুর মাছের পুষ্টিগত গুরুত্ব
বড় অনেক প্রজাতির তুলনায় শিং ও মাগুর মাছের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। এসব মাছে শরীরের উপযোগী লৌহ অধিক পরিমাণে আছে। এসব মাছে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি ও তেল কম থাকে। এজন্য সহজে হজম হয়। অসুস্থ ও রোগ মুক্তির পর স্বাস্থ্যের দ্রুত উন্নতির জন্য পথ্য হিসেবে এসব মাছ সমাদৃত। শিং ও মাগুর মাছ রক্ত স্বল্পতা রোধে ও বল বর্ধনে সহায়তা করে।

চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি
শিং ও মাগুর মাছ চাষের জন্য পুকুর ১-১.৫ মিটার গভীর হওয়া দরকার। পুকুরের আয়তন ১০ শতক থেকে ৩০ শতক হলে ভালো হয়। চাষের জন্য নির্বাচিত পুকুরটির পাড় ভাঙা থাকলে তা মেরামত করতে হবে। পুকুরে কচুরিপানা সহ অন্যান্য জলজ আগাছা থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। পাড়ে বড় গাছপালা থাকা উচিত নয়। পুকুরে রাক্ষুসে ও অপ্রয়োজনীয় মাছ থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। পুকুর শুকিয়ে, বার বার জাল টেনে বা পুকুরের পানিতে রোটেনন প্রয়োগ করে তা করা যায়। শীতকালে যখন পুকুরের পানি অনেক কমে যায় তখন পুকুর শুকিয়ে ফেলে পুকুর প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন করলে ভালো হয়। পুকুর শুকানো হলে তলায় চুন, গোবর বা হাঁসমুরগির বিষ্ঠা, ইউরিয়া, টিএসপি সার প্রতিশতকে নির্ধারিত হারে যথাযথ নিয়মে প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে যদি পানি থাকে তাহলে পানিতেই চুন ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
মাগুর মাছের পুকুরে নেটের বেষ্টনী
নেটের বেষ্টনী/বেড়া নির্মাণ
শিং ও মাগুর মাছ চাষে পুকুর প্রস্তুতির সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পুকুরের চারদিকে পাড়ের উপর অন্তত ৩০ সে.মি. উঁচু করে নেটের বেষ্টনী বা বেড়া নিমার্ণ করা। বেষ্টনী দেওয়ার সুবিধা হচ্ছে এতে করে বৃষ্টির সময় মাছ পুকুরের বাইরে চলে যেতে পারে না। বিশেষত মাগুর মাছকে সামান্য বৃষ্টি বা বন্যা হলে প্রায়ই হেঁটে (গড়িয়ে) পুকুর থেকে বাইরে যেতে দেখা যায়। অন্যদিকে বেষ্টনী দেওয়ার ফলে মাছের শত্রু যেমন-সাপ,ব্যাঙ ইত্যাদি পুকুরে প্রবেশ করতে পারে না। নাইলনের নেট খুটির সাথে বেঁধে পাড়ের চারদিকে ঘিরে দিতে হবে। নেটের নিচের দিক মাটির ভিতর কিছুটা ঢুকিয়ে আটকে দিতে হবে যেন মাটি ও নেটের মাঝে ফাঁক না থাকে। পুকুর শুকানো হলে শুকানোর পর পরই এ কাজ করতে হবে। কারণ শুকনো অবস্থায় পুকুরে কোনো ক্ষতিকর প্রাণী যেমন-ব্যাঙ, সাপ থাকে না। পানি থাকা অবস্থায় পুকুরে এসব প্রাণী থাকে বিধায় তখন বেষ্টনী দিলে এরাও পুকুরে আটকা পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ভিতরে সেগুলোকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- কোচ দিয়ে বা বিষ টোপ দিয়ে।

পোনা মজুদ
পুকুর প্রস্তুতির ৫-৭ দিন পর পুকুরে প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ টি মাগুর মাছের পোনা মজুদ করতে হবে। শিং মাছ যেহেতু আকারে ছোট তাই এ মাছ কিছু বেশি যেমন- ৩০০-৪০০টি পর্যন্ত মজুদ করা যেতে পারে। শতকে ৩-৪টি সিলভার কার্পের পোনা ছাড়া যেতে পারে যা পুকুরে উৎপাদিত অতিরিক্ত ফাইটোপস্নাংকটন খেয়ে পরিবেশ ভালো রাখবে। পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা থাকলে শতকে মাগুরের পোনা ২৫০-৩০০টি এবং শিং মাছের পোনা ৪০০-৫০০টি মজুদ করা যাবে। কার্প বা রুই জাতীয় মাছের সাথে শিং/মাগুর এর মিশ্রচাষ করতে চাইলে শতকে শিং/মাগুর এর পোনা ৫০টি এবং রুই জাতীয় মাছের পোনা ৪০টি মজুদ করা যায়। পোনা ছাড়ার আদর্শ সময় হচ্ছে সকাল বা বিকাল (ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়)। দুপুরে রোদে বা মেঘলা দিনে পোনা মুজুদ করা উচিত নয়। পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পটাশ বা লবণ পানিতে পোনা শোধন ও পুকুরের পানিতে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।

মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
খাদ্য ব্যবস্থাপনা মাগুর ও শিং মাছ চাষে মাছকে সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে। নিচে মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন খাদ্য উপাদান ও এগুলোর মিশ্রণের হার দেওয়া হলো-
শিং ও মাগুরের সম্পুরক খাদ্য তৈরির উপাদান ও মিশ্রণ হার।
খাদ্য উপাদান ⇒ মিশ্রণ হার (%)
ফিশমিল ⇒ ২০
মুরগির নাড়ি ভুড়ি ও হাড় চুর্র্ণ (মিট ও বোন মিল) ⇒ ২৫
সরিষার খৈল ⇒ ৩০
চালের কুঁড়া ⇒ ১২
গমের ভুসি ⇒ ৫
আটা/ চিটাগুড় ⇒ ১ গ্রাম/কেজি
ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ ⇒ ৮
সয়াবিন চূর্ণ ⇒ ৫
ভুট্টা চূর্ণ ⇒ ৫

শিং/মাগুর মাছের দৈহিক ওজনের সাথে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা নিচে দেওয়া হলো-
মাছের গড় ওজন (গ্রাম)⇒ দৈহিক খাদ্যের পরিমান (%)
১-৩ ⇒ ১৫-২০
৪-১০ ⇒ ১২-১৫
১১-৫০ ⇒ ৮-১০
৫১-১০০ ⇒ ৫-৭
>১০১ ⇒ ৩-৫

খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি: প্রতিদিনের খাবার ২ ভাগ করে দিনে ২ বার (সকাল ও বিকালে) দিতে হবে। খাবার অল্প পানিতে মিশিয়ে ছোট ছোট বল করে পুকুরের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে পানির নিচে স্থাপিত ট্রেতে দেওয়া যাবে। খাদ্য প্রস্তুতের ২৪ ঘণ্টা পূর্বেই সরিষার খৈল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। বাজার থেকে কেনা বাণিজ্যিক খাবারও মাছকে প্রদান করা যায়। এতে তৈরিকৃত খাদ্যের চেয়ে দাম কিছুটা বেশি পড়তে পারে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা চাষকালীন মাছ নিয়মিত বাড়ছে কিনা এবং মাছ রোগাক্রান্ত হচ্ছে কিনা জাল টেনে মাঝে মাঝে তা পরীক্ষা করতে হবে। শিং ও মাগুর মাছে সাধারণত কোনো রোগ হয় না। তবে মাঝে মাঝে শীতকালে ক্ষত রোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ এবং পেট ফোলা রোগ দেখা যায়। নিচে এদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দেওয়া হলো:

ক্ষত রোগ: মূলতঃ এ্যাফানোমাইসিস ইনভাডেন্স নামক একধরনের ছত্রাকের আক্রমণ এ রোগ হয়। এতে মাংশপেশিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পুকুরে ১-১.৫ মিটার পানির গভীরতায় শতকে ১ কেজি হারে চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করলে আক্রান্ত মাছগুলো ২ সপ্তাহের মধ্যে আরোগ্য লাভ করে। আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে শীতের শুরুতে একই হারে পুকুরে চুন ও লবণ প্রয়োগ করলে শীতকালে এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।

লেজ বা পাখনা পচা রোগ: এ্যারোমোনাডস ও মিক্সোব্যাকটার জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়। প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পারমেঙ্গানেট মিশ্রিত করে আক্রান্ত মাছকে ৩-৫ মিনিট গোসল করাতে হবে। পুকুরে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। প্রতি শতক পুকুরে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে।

পেট ফোলা রোগ: এটি একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ। এ রোগ হলে মাছের পেট ফুলে যায়। মাছ ভারসাম্যহীন ভাবে চলাচল করে ও পরিশেষে মৃত্যু ঘটে। আক্রান্ত মাছের পেট হতে খালি সিরিঞ্জ দিয়ে পানি বের করে নিতে হবে। প্রতি কেজি খাবারের সাথে ২০০ মি.গ্রাম ক্লোরামফেনিকল পাউডার মিশিয়ে সরবরাহ করতে হবে। আক্রান্ত পুকুরে প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা যায়।

মাছ আহরণ সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে ৭-১০ মাসে শিং ও মাগুর মাছ বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়। উক্ত সময়ে শিং মাছ গড়ে ১০০-১২৫ গ্রাম ও মাগুর মাছ ১২০-১৪০ গ্রাম হয়ে থাকে। পুকুরে জাল টেনে বেশির ভাগ মাছ ধরতে হবে। সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করতে হলে পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে। 








পাংগাস মাছের লাভজনক মিশ্র চাষ

ভূমিকা
দেশে থাই পাংগাসের আমদানি এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটায় মাছ চাষে বৈপ¬বিক পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু পুকুর-দিঘীর ইজারা মূল্যসহ চাষের উপকরণের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির ফলে চাষিরা আর আগের মতো লাভবান না হতে পেরে অনেকটা দিকভ্রষ্ট হয়ে বিকল্প লাভজনক মাছচাষ পদ্ধতি খুঁজতে থাকেন। একদিকে পাংগাসের সহজ চাষ ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন মাত্রা অধিক হলেও পাংগাস চাষে লাভ না থাকলেও চাষি এ মাছ চাষ পরিত্যাগ করতে আগ্রহী নন। অপর দিকে, দেশীয় কার্প জাতীয় মাছের স্বল্প উৎপাদন হার এবং একক আয়তনের জলাশয়ে অধিক লাভের প্রবণতা চাষিকে মাছ চাষের নানা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করে। সমাধানের উপায় হিসেবে বাণিজ্যিক মাছ চাষিগণ থাই পাংগাসের সাথে নানা প্রজাতির মাছ সাথি ফসল হিসেবে কিভাবে লাভজনকভাবে চাষ করা যায় তার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। পাংগাস মাছের সাথে তেলাপিয়া, কৈ, গলদা চিংড়ি এবং শিং-মাগুর প্রভৃতি মাছচাষ করা হচ্ছে বিগত কয়েক বছর যাবত। নানা বিকল্প মাছ চাষ ব্যবস্থাপনার মধ্যে বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে বিশেষ করে ব্যাপকভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা অঞ্চলে অত্যন্ত সফলতার সাথে পাংগাস মাছের সাথে তেলাপিয়া (মনোসেক্স) এবং শিং মাছ একত্রে চাষ করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। এ পদ্ধতিতে একক আয়তনের জলাশয়ে মাছের উৎপাদন এবং আর্থিক লাভও অনেক বেশি। এখানে লক্ষণীয় যে, উলি¬খিত তিনটি প্রজাতির মাছ এককভাবে চাষযোগ্য তবে এদের একক চাষের তুলনায় মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ অনেক বেশি লাভজনক। জলাশয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি জলাশয়ের তলদেশের পরিবেশ জৈবিক উপায়ে সংরক্ষিত হওয়ায় এ পদ্ধতি বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ এবং মাছ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য লাভজনকভাবে এ মাছচাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।


চাষের জন্য স্থান নির্বাচন

বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছ চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য আলোচ্য মাছচাষ কল্পে ধান ক্ষেতকে স্বল্প গভীরতায় বেড়ী বাঁধ দিয়ে ঘেরে (Paddy Land Temporarily Converted to Low Depth Pond) পরিণত করা জলাশয় বেশ উপযোগী। তবে যে সকল জলাশয় সহজে শুকানো যায়, প্রয়োজনমত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে, উৎপাদিত মাছ ও খাদ্য উপকরণ সহজে পুকুর পাড়ে পরিবহন করার মতো যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে এবং সর্বোপরি পর্যাপ্ত সূর্যের আলো দীর্ঘ সময় পুকুরে পড়ে এরূপ পুকুর নির্বাচন করতে হবে। উপযুক্ততা বিবেচনা না করে যে কোনো পুকুরে এ ধরনের অগ্রসর পদ্ধতির মাছ চাষ করতে গেলে সফলতা পাওয়া কঠিন হয়।
পুকুর প্রস্তুতি
চাষের পুকুর অবশ্যই ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। পুকুর শুকানোর পর চুন প্রয়োগ করতে হবে শতকে এক কেজি হারে। পুকুরের তলদেশে যদি কাদা থেকে যায়, তবে চুন কাদার সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পুকুরে যদি ইতোপূর্বে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা হয়ে থাকে তবে চুনের পাশাপাশি শতকে ৫০০ গ্রাম হারে পটাশ সার (Murate of Potash) দিতে হবে। চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের পানির গভীরতা এক মিটার হওয়া উত্তম। পুকুরে কোনো প্রকার জৈব সার দেয়া যাবে না।

পোনা মজুদ
পোনা মজুদের জন্য পরিচিত মৎস্য খামার থেকে ভালোমানের পাংগাস (১৮-২০ সেমি), তেলাপিয়া (৬-৮ সেমি) এবং শিং মাছের (৭-৮ সেমি) পোনা সংগ্রহ করতে হবে। সাথে কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছাড়তে হবে ১৪-১৬ সেমি আকারের। এ আকারের পোনা পাওয়া নিশ্চিত করা এবং চাষে অধিক লাভবান হবার জন্য ধানি পোনা সংগ্রহ করে নিজস্ব পুকুরে উপযুক্ত আকার পর্যন্ত বড় করে নিতে হবে। চাষের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে ভালোমানের উপযুক্ত আকারের পোনার ওপর। একটি এক একর পুকুরে পোনা ছাড়ার পরিমাণ নিম্নে দেয়া হলো:
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
মাছের খাদ্য প্রদানের মূল নীতি হলো, মাছ যে পরিমাণ খাবার খেতে পারে ঠিক সেই পরিমাণ খাদ্য প্রতিদিন সময়মত নির্ধারিত স্থানে প্রদান করা। সে উদ্দেশ্যে পোনা ছাড়ার পর হতে নিয়মিতভাবে দিনে দুবার মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ১০-৩ ভাগ হারে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্যে আমিষের ভাগ ৩০% হতে হবে। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির বাণিজ্যিক খাবার (Pillet Feed) এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগের সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন মাছ সবটুকু খাবার খেয়ে ফেলে। কারণ অভুক্ত খাদ্য পচে পরিবেশ নষ্ট করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। খাদ্যের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ফিড ট্রে (Feeding Tray) পদ্ধতি উত্তম। এক একর পুকুরে ১ মি. × ১ মি. মাপের ২০টি ট্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ট্রেসমূহ পানি থেকে ০.৫ মি. গভীরতায় ঝুলিয়ে দিতে হবে। বাঁশের চাটাই দ্বারা মাচা (Platform) তৈরি করেও তার উপর খাবার দেয়া যেতে পারে। খাবার দেবার ১ ঘন্টা পরে ফিড ট্রে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে মাছ সব খাবার খাচ্ছে কি না। সব খাবার গ্রহণ না করলে খাদ্য প্রদান অবশ্যই কমিয়ে দিতে হবে।

মাছের নমুনাকরণ এবং খাদ্য সমন্বয়
বাণিজ্যিক মাছ চাষের পুকুরে খাদ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছ চাষ করার প্রতি ১২-১৫ দিন পরপর কাস্ট নেট দিয়ে ছোট অবস্থায় বেশি এবং বড় হলে কমপক্ষে ৫০টি মাছ ধরে গড় ওজনের মাধ্যমে মোট মাছের ওজন (Biomass) হিসাব করতে হবে। মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে খাদ্য প্রয়োগের হার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। তবে কমাবার হার বা খাদ্য প্রয়োগের হার প্রকৃতপক্ষে মাছের খাদ্য গ্রহণ এবং পানির পরিবেশের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। পানির রং ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আবার নতুন তৈরি জলাশয়ে যে পরিমাণ খাদ্য মাছকে দেয়া যায় পুরাতন পুকুরে সে পরিমাণ খাদ্য দেয়া যায় না অর্থাৎ পুরাতন পুকুরের পানি দ্রুত সবুজ হয়ে আসে। ফলে, খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হয়। খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা (Food Conversion Ratio) অধিক হলে জলাশয়ের পরিবেশ ভালো থাকে বিধায় ভালো মানের খাদ্য কম হারে প্রয়োগ করে মাছের বেশি বর্ধন পাওয়া যায়। আবার যে সব পুকুরে নিয়মিত পানি পরিবর্তন করা হয় সে সব পুকুরের মাছ বেশি খাদ্য খায়। ফলে এক্ষেত্রে খাদ্য বেশি দিতে হয়। এক কথায় মাছকে যত বেশি খাবার খাওয়ানো যাবে মাছের বর্ধন তত দ্রুত হবে এবং মাছের উৎপাদনও বেশি পাওয়া যাবে।

অন্যান্য পরিচর্যা
পুকুর/ঘেরের পানির পরিবেশ ভালো রাখার জন্য (অবস্থা বুঝে) ঘেরের পানি আংশিক পরিবর্তন করতে হবে এবং প্রতি ১৫ দিন অন্তর শতকে ২৫০ গ্রাম হারে চুন ও খাদ্য লবণ একত্রে বা পর্যায়ক্রমে প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়াও অবস্থা বুঝে শতকে ২৫০ গ্রাম হারে পটাশ সারও প্রয়োগ করতে হতে পারে। এ সকল পদক্ষেপ ছাড়াও ঘেরের তলদেশে জমে থাকা ক্ষতিকর গ্যাস অপসারণের জন্য ২-৩ দিন পর পর দুপুরের সময় পানিতে নেমে অথবা হররা টেনে পানির তলদেশ আলোড়িত করার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরে গ্যাস সৃষ্টির প্রধান কারণ খাদ্যের উচ্ছিষ্টাংশ জমা হওয়া। খাদ্য প্রয়োগের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য কোনো ভাবেই প্রয়োগ করা না হয়। মাছ চাষে পুকুরের পানি অধিক সবুজ, পুকুরের তলদেশে ক্ষতিকর গ্যাস সৃষ্টি হওয়া ও পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিলে অনেক সময় কিছু মাছ মারাও যেতে পারে। পুকুরের সার্বিক পরিবেশ ভালো রাখার জন্য জিওলাইট, একুয়াম্যাজিক এবং ক্ষতিকর গ্যাস হতে মাছ রক্ষার জন্য গ্যাসনেক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। অক্সিজেনের অভাব হলে পুকুরে পানি দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের পানি অধিক সবুজ হয়ে গেলে পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে। তুতে বা অন্যান্য কিছু রাসায়নিক দ্রব্য (Blue Lagoon) ব্যবহার করে সাময়িকভাবে সবুজভাব (Phytoplankton) দূর করা গেলেও তা ক্ষণস্থায়ী হয়। পুকুরে অধিক ঘনত্বে মাছ থাকলে খাবার দিলে মাছ পানির উপরের স্তরে চলে আসে বিধায় শিকারী পাখি দ্বারা মাছ ধরে নেবার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পুকুরের উপর নেট দ্বারা আবৃত করে দেয়া যেতে পারে। এভাবে ৮-৯ মাস চাষের পর পাংগাস মাছ গড়ে প্রায় ১০০০-১১০০ গ্রাম ওজনের হয়। এসময় পাংগাস মাছসহ অন্যান্য মাছ বাজারে পাঠানোর উপযুক্ত হয়ে ওঠে।

মাছ বাজারজাতকরণ
তেলাপিয়া ও শিং মাছের বাজার দর সকল সময়ই ভালো থাকে। তবে সার্বিকভাবে বাজারের অবস্থা বুঝে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট বাজারের থেকে দেশের বড় বাজারসমূহে বড় আকারের মাছের চাহিদা বেশি থাকে। শিং এবং পাংগাস মাছ জীবিতাবস্থায় বাজারজাতকরণের জন্য পস্টিক ড্রামে করে মাছ বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
 

এক একর একটি পুকুরে মাছ উৎপাদনের আয় ও ব্যয়ের হিসাব (*টাকার হিসেব সমূহ সমসাময়িক সময়ের হিসাবে সম্বনয় করে নিতে 













ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষ

গলদা চিংড়ি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য সম্পদ। দেশের প্রায় সকল এলাকার স্বাদুপানির জলাশয় গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা আছে বিধায় গলদা চিংড়ি চাষ যথেষ্ট লাভজনক। দেশের অপেক্ষাকৃত নিচু ধানের জমিতে ঘের পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে। ঘের হলো অপেক্ষাকৃত নিচু ধানের জমি যার চারপাশে উঁচু জমি থাকে অথবা মাটির শক্ত বাঁধ থাকে। বর্ষাকালে ঘের পানিতে ভরে যায় বলে এই মৌসুমে ধান চাষ করা সম্ভব হয় না। ঘেরে এপ্রিল-মে বা বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে ধান কাটার পর গলদা চিংড়ির চাষ করা হয় অর্থাৎ ঘেরে প্রথমে ধান চাষের পর সেখানে চিংড়ি চাষ করা হয়। আবার চিংড়ি আহরণ করার পর সেখানে ধান চাষ করা হয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘের পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও অনেক নিচু জমি রয়েছে যেখানে শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষ হয় কিন্তু বর্ষাকালে সেগুলো পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এসব জমিতে চিংড়ির চাষ করে যথেষ্ট লাভবান হওয়া যায়।
ঘেরের বৈশিষ্ট্য
একটি ঘেরের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকলে তা গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা যায়ঃ
* গলদা চিংড়ি চাষের জন্য নির্বাচিত ঘেরে ৪-৬ মাস ৩.০-৪.০ ফুট উচ্চতার পানি ধরে রাখার সুবিধা থাকতে হবে।
* ঘেরের মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি থাকতে হবে যাতে ঘের তাড়াতাড়ি শুকিয়ে না যায়।
* সাধারণত দোআঁশ বা বেলে-দোআশ মাটির ঘের গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত।
* ঘের একটু নিচু জায়গায় হলে পানি ধরে রাখতে সুবিধা হয়।
* ঘেরে বন্যার পানি যেন প্রবেশ না করতে পারে এবং বন্যা বা বৃষ্টির পানিতে বাঁধ যেন প্লাবিত না হয়। নিচু ঘেরের বাঁধ উঁচু করে বেঁধে বন্যামুক্ত করে চিংড়ি চাষের উপযুক্ত করা যায়।
* ঘেরের আকার ৩০-১০০ শতাংশ হলে ব্যবস্থাপনার জন্য সুবিধা হয়।
* ঘেরে যথেষ্ট সূর্যালোক পড়তে হবে।
* ঘেরে উৎপাদিত চিংড়ি বাজারজাত করার সুবিধা থাকতে হবে।


মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা
ঘের প্রস্তুতকরণ
ঘেরে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে ঘের প্রস্তুতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঘের যত ভালভাবে প্রস্তুত করা হবে চিংড়ির উৎপাদন তত বেশি হবে। এজন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাঁধ নির্মাণ
* ঘেরের চারপাশে বাঁধ বা উঁচু জমি না থাকলে সেখানে বাঁধ নির্মাণ করে নিতে হবে। যে সব ঘেরের বাঁধ বা চারপাশের জমি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় না তেমন ঘের নির্বাচন করতে হবে।
* বাঁধ ভাঙ্গা থাকলে তা মেরামত করতে হবে।
* বাঁধ যথেষ্ট শক্ত হতে হবে যাতে পানির চাপে ভেঙ্গে না যায় এবং চিংড়ি বের হয়ে যেতে না পারে।
* বাঁধ যথেষ্ট উঁচু হওয়া উচিত যাতে বন্যার পানি সেখানে প্রবেশ না করতে পারে।
* বাঁধ যথেষ্ট প্রশস্ত করে তাতে শাকসবজির চাষ করা যেতে পারে।

নালা খনন
* চিংড়ির চলাচল এবং অবস্থানের সুবিধার্থে ঘেরে নালা খনন করতে হবে।
* নালা খননের ফলে এতে সবসময় পানি ধরে রাখা সম্ভব হয়।
* অত্যধিক গরমের সময় চিংড়ি নালায় এসে আশ্রয় নিতে পারে।
* ঘেরে যখন ধান চাষ হয় তখন নালা নার্সারী হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
ঘেরের মাটি এবং জমির উপরিপৃষ্ঠের ধরনের উপর ভিত্তি করে ঘেরের চতুর্দিকে, মাঝখানে অথবা যে কোনো এক বা দুই পাশে নালা খনন করা যায়। বাঁধের ভিতরে জমির সমতা বা ঢাল অনুসারে নালা খনন করতে হবে। নালার দৈর্ঘ্য হবে ঘেরের আয়তনের অনুপাতে। নালার প্রস্থ কমপক্ষে ৪-৬ ফুট এবং সমতল এলাকা থেকে গভীরতা ১.৫-২.০ ফুট হলে ভাল।

পানি নির্গমন পথ তৈরি
বর্ষাকাল বা অন্য যে কোনো কারণে যদি ঘের পানিতে পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়ার জন্য বাঁধে পানি নির্গমন পথ তৈরি করতে হবে। চিংড়ি যাতে বের হয়ে যেতে না পারে সে জন্য নির্গমন পথের মুখে জাল বা বাঁশের বানা স্থাপন করতে হবে।

নালা শুকানো, কাদা অপসারণ ও চাষ দেওয়া
নালা থেকে পানি নিষ্কাশন করে কাদা অপসারণের পর তা রৌদ্রে শুকাতে হবে । নালা ও জমিতে চাষ দিতে হবে এবং ধানের গোড়া অপসারণ করতে হবে।

চুন ও সার প্রয়োগ
নালা ও সমস্ত জমিতে ১ কেজি/শতাংশ হিসাবে চুন প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে এবং নালার জৈব সার (প্রতি শতাংশে ৫-৬ কেজি গোবর, অথবা ৮-১০ কেজি কম্পোষ্ট অথবা ৩-৫ কেজি হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠা) প্রয়োগ করতে হবে এবং তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। পানি প্রবেশ করানোর পর অজৈব সার (প্রতি শতাংশে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০-৭৫ গ্রাম টিএসপি) প্রয়োগ করতে হবে।

পানি প্রবেশ করানো
ধানকাটার পর ঘের সাধারণত আস্তে আস্তে বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়। তবে নালা শুকনোর পর তাতে জুভেনাইল (চিংড়ি পোনা) মজুদ করতে চাইলে অন্যান্য উৎস, যেমন-ডিপ টিউবয়েল, আশপাশের নদী,খাল, দীঘি ইত্যাদি থেকে পানি সরবরাহ করতে হবে।

আগাছা অপসারণ
ঘেরের বাঁধে সূর্যালোককে বাধাদানকারী গাছপালা থাকলে তা অপসারণ বা ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। নালা যদি শুকনো সম্ভব না হয় তবে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।

রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত প্রাণী দূরীকরণ
নালা যদি শুকানো সম্ভব না হয় তবে রোটেনন বা অন্য কোন বিষ প্রয়োগ করে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত জলজ প্রাণী দূর করতে হবে।

আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করা
ঘের পানিতে পূর্ণ হলে তাল, নারিকেল ও খেজুরের পাতা, বাঁশের কঞ্চিসহ আগালি, প্লাস্টিকের ভাঙ্গা পাইপ ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করে জুভেনাইলের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

জুভেনাইল মজুদ
গলদা চিংড়ির পোনাকে পিএল (post larvae) বলা হয় এবং অপেক্ষাকৃত বড় পোনাকে জুভেনাইল বলা হয়। ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে জুভেনাইল-এর আকার একটু বড় হতে হবে এবং তা কমপক্ষে ৫.০ সে.মি. আকারের হলে ভাল হয়। নার্সারী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পিএল থেকে জুভেনাইল তৈরি করে তা ঘেরে ছাড়তে হবে। ঘেরের নালা বা নালার একটি অংশ অথবা আলাদা ছোট পুকুর নার্সারী হিসাবে ব্যবহার করা যায়। ঘেরে জুভেনাইল মজুদ হার নির্ভর করে চাষ পদ্ধতি, চাষের সময়কাল, জুভেনাইলের প্রাপ্যতা, মাটি ও পানির গুণাগুণ, ব্যবস্থাপনা কলাকৌশল ইত্যাদির উপর। যদি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর নির্ভর করা হয় তবে মজুদ ঘনত্ব কম হবে, তৈরি খাদ্য সরবরাহ করলে মজুদ ঘনত্ব বেশি হবে, পাশাপাশি পানি পরিবর্তন ও বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা থাকলে মজুদ ঘনত্ব আরও বেশি হবে। তৈরি খাদ্য সরবরাহ করলে প্রতি শতাংশে ৪০-৬০টি জুভেনাইল ছাড়তে হবে। অতিরিক্ত প্লাংকটন নিয়ন্ত্রণের জন্য শতাংশ প্রতি ২-৪টি সিলভার কার্প এবং কাতলার পোনা ছাড়তে হবে। জুভেনাইল ছাড়ার আগে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। মে-জুলাই মাসে জুভেনাইল ছাড়তে হয়। এ সময় জমিতে ২-৩ ফুট পানি থাকলে ভাল হয়। জমিতে পানি না থাকলে ঘেরের নালায় জুভেনাইল ছাড়তে হবে।
অনেক সময় ঘেরের নালা বা নালার অংশ নার্সারী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। নালায় পিএল লালন করার পর বৃষ্টিতে যখন নালা পরিপূর্ণ হয়ে পানি সারা ঘেরে ছড়িয়ে পড়ে তখন জুভেনাইলও সারা ঘেরে ছড়িয়ে পরে। এক্ষেত্রে কী পরিমাণ জুভেনাইল মজুদ করা হলো তা জানা সম্ভবপর হয় না। কিন্তু উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ঘেরে কী পরিমাণ জুভেনাইল ছাড়া হলো তা অবশ্যই জানা দরকার। তাই নালাতে উৎপাদিত জুভেনাইল অবশ্যই গণনা করে সারা ঘেরে ছাড়তে হবে।

মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা

প্রাকৃতিক খাদ্য
চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্যে গলদা চিংড়ি চাষকালীন সময়ে পুকুরে ১৫ দিন পর পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। অথবা ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৪ কেজি গোবর প্রয়োগ করতে হবে। তবে সার প্রয়োগের মাত্রা পুকুরে প্রাকৃতিক খাবারের উপস্থিতির উপর নির্ভর করবে।

সম্পুরক খাদ্য
ঘেরে নিয়মিত সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। নিচের সূত্র অনুযায়ী নিজেরা খাদ্য তৈরি অথবা বাণিজ্যিকভাবে খাদ্য ক্রয় করা যেতে পারে।

সারণী ১. গলদা চিংড়ির জন্য খাদ্য তৈরির সূত্র

চিংড়ির বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
চিংড়ি ঘেরে ছাড়ার পর থেকে গলদা চিংড়ির বৃদ্ধির হার প্রথমে বেশি থাকে এবং পরবর্তীতে কমতে থাকে। চিংড়ি বেঁচে থাকার হার, দৈহিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, রোগ-বালাই ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের জন্য নালা থেকে ঝাঁকি জাল দ্বারা ৫-৭ বার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে হবে। সকালে বা বিকালে এ কাজটি করতে হবে। রোগলক্ষণ পরিলক্ষিত হলে সাথে সাথেই প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘের নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে এবং কোনো অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হলে সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পানির গুণাগুণ অনুকূল মাত্রায় রাখতে হবে। অতি বৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে ঘেরের পানি দ্রুত বেড়ে গেলে নির্গমন নালার মাধ্যমে পানি বের করে নিতে হবে।

চিংড়ি আহরণ ও উৎপাদন
অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে ঘেরের পানি কমে গেলে চিংড়ি আহরণ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষে একর প্রতি ২০০-২৫০ কেজি উৎপাদন হয়ে থাকে।
বড় গ্রেডের প্রতি কেজি চিংড়ির মূল্য অপেক্ষাকৃত ছোট চিংড়ির তুলনায় অনেক বেশি বিধায় আহরণের পর কিছু চিংড়ি পুনরায় নালায় মজুদ করা হয় যাতে পরবর্তী মৌসুমে বৃদ্ধি পেয়ে বড় গ্রেডের চিংড়িতে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকলে অধিকাংশ চিংড়ি মারা যেতে পারে। চাষের শুরুতে আগের বৎসরের ওভার উইন্টার (বাড়তি মজুদের পোনা) করা জুভেনাইল মজুদ করলে এক মৌসুমেই বড় গ্রেডের চিংড়ি পাওয়া সম্ভব।
একটি ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের আয়-ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব নিচে দেখানো হলো।

সারণী ২. এক একরের একটি ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের আয়-ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব-

উপসংহারঃ
স্বাদুপানির চিংড়ির মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতি হলো গলদা চিংড়ি। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পানি গলদা চিংড়ি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। গলদা চিংড়ি বাগদা চিংড়ির চেয়ে কম রোগাক্রান্ত হয়। সারাদেশের অসংখ্য পুকুর জলাশয়ের পাশাপাশি নিচু ধানক্ষেতে ধানের সাথে বা ঘের পদ্ধতিতে ধান কাটার পরে গলদা চিংড়ির চাষ করলে চিংড়ি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে



কার্পজাতীয় মাছের ব্রুড প্রতিপালন

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে মাছের মোট উৎপাদন (২০০৬-০৭) প্রায় ২৪.৪০ লক্ষ মেট্রিক টন। এর মাঝে চাষের মাধ্যমে (Aquaculture) উৎপাদিত মাছের পরিমাণ প্রায় ৯.৪৬ লক্ষ মেট্রিক টন, যা মোট মাছের উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, চাষে ব্যবহৃত মাছের পোনার প্রায় ৯০ শতাংশ আসে দেশের ছোট-বড় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের মোট ৮০০টি হ্যাচারির পোনা থেকে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার গুণগতমানের ওপর নির্ভর করছে চাষের অধীনে মাছের উৎপাদনের সফলতা। হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার গুণগতমান নির্ভর করে হ্যাচারির ব্রুড মাছের গুণগতমানের ওপর। এ ক্ষেত্রে সহজেই অনুমেয় যে, ভালোমানের পোনা উৎপাদনে ব্রুডমাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বড় আকারের মাছ হলেই কি ব্রুডমাছ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে? প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তা হলে ব্রুডমাছ মাছ বলতে কী বোঝায় সেটা জানা প্রয়োজন। একটি সুনির্দিষ্ট প্রজনন কর্মসূচির মাধ্যমে উৎপাদিত পোনা, অথবা প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত পোনা, সঠিক ব্যবস্থাপনায় একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত লালিতপালিত করার পর একটি নির্দিষ্ট ওজন লাভ করলে সেটাকে ব্রুডমাছ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে। মানসম্পন্ন ব্রুডমাছের বৈশিষ্ট্য হলোঃ
* মাছটি প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত হতে হবে
* অথবা উত্তম কৌলিতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হতে হবে
* মাছের বর্ধন হার বেশি হতে হবে
* বংশপরম্পরায় রোগমুক্ত হতে হবে
* মাছের ডিম হার অধিক (highly fecund) হবে
* শারীরিক গঠন ও রং স্বাভাবিক হবে
* প্রজনন উপযোগী বয়স ও ওজন বিশিষ্ট হবে
কাতল মাছ
চিত্রঃ প্রাকৃতিক উৎসের কাতল মাছ

দেশে এরূপ কার্প হ্যাচারির সংখ্যা খুবই কম যেখানে ব্রুড উৎপাদনের নিজস্ব কর্মসূচি আছে বা উন্নত ব্রুড সংগ্রহের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হয়ে থাকে। উপরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যযুক্ত ব্রুডমাছ হলেই ভালো পোনা পাওয়া যাবে। তবে, ব্রুডমাছের চাষ ব্যবস্থাপনাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রেণু উৎপাদন মৌসুমে ভালো মানের পোনা মৌসুমের শুরুতেই প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য ব্রুডমাছ কীভাবে প্রতিপালন করা হবে বা প্রজনন মৌসুমের আগে বিশেষ করে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ব্রুডের যত্ন কীভাবে নেয়া হবে সে বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

১. ব্রুডমাছের পুকুর নির্বাচন
সঠিকভাবে ব্রুডমাছ প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পুকুর নির্বাচনের বিষয়ে সবিশেষ নজর দিতে হবে কারণ যে কোনো পুকুরে ব্রুড সংরক্ষণ বা প্রতিপালন করা যায় না। পানি আছে এবং মাছ বেঁচে আছে তার মানে এটা নয় যে, মাছ ভালো অবস্থায় আছে। ব্রুড মাছের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো মাছ যাতে কোন অবস্থায় ধকলের সম্মুখীন না হয়। ব্রুড মাছের পুকুরের যে সব বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকতে হবেঃ
* পুকুরের আকার হতে হবে কমপক্ষে ১.০০ একর
* পানির গভীরতা হতে হবে ১.৫-২.০ মিটার (৪.৯২-৬.৫৬ ফুট)
* পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পুকুরে পড়তে হবে যাহাতে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হতে পারে
* পুকুরে বাতাসের প্রবাহ যেন বাধাগ্রস্থ না হয়
* পুকুরের তলদেশে কাদার গভীরতা ৬-৯" এর বেশি না হয়
* প্রয়োজনে পানি দেবার জন্য পুকরের নিকটে পানির উৎস থাকতে হবে
* পুকুরের দূরত্ব এমন হবে যাতে হ্যাচারিতে মাছ পরিবহনে ১০-১৫ মিনিটের কম সময় লাগে

২. পুকুর প্রস্তুতি
পুকুর নির্বাচনের পর পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। সেজন্য কতকগুলো কাজ করতে হবে। সেগুলো নিম্নরূপঃ
* পুকুর মৎস্যশূন্য করা
পুকুরের পানিতে ব্রুডমাছের সাথে নানা প্রকার অপ্রয়োজনীয় মাছ থাকতে পারে যা ব্রুডমাছের আবাস এবং খাদ্যে অংশীদার হয়ে ব্রুডমাছের ক্ষতি করে থাকে। এজন্য পুকুর শুকালে সবচেয়ে ভালো হয়। শুকানো পুকুরের অপ্রয়োজনীয় মাছ সহজেই সরানো যায়, পুকুরের পাড় মেরামত করা যায় এবং পুকুরের তলদেশ রৌদ্রে শুকানো যায়। ফলে, পুকুরের তলদেশ দূষিত গ্যাসের সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায়। এতে পুকুরের উর্বরা শক্তি ফিরে আসে ও সার্বিক পরিবেশের উন্নতি ঘটে। শুকাতে না পারলে প্রথমে জাল টেনে মাছ সরিয়ে শতকে ৩০ সেমি. (১ ফুট) গভীরতার জন্য ৩০ গ্রাম রোটেনন প্রয়োগ করে অপ্রয়োজনীয় মাছ নিধন করতে হয়। পুকুরের পাড়ের গাছের ডাল ছেঁটে দিতে হবে যাতে পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়তে পারে।
* পুকুরে চুন প্রয়োগ
পুকুরে কাদার পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে শতকে ১-২ কেজি পাথুরে চুন পানিতে গুলিয়ে অথবা গুঁড়া করে পুকুরে ভালোভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুর শুকানো হয়ে থাকলে চুন প্রয়োগের পর পানি প্রবেশ করাতে হবে।
* পুকুরে সার প্রয়োগ
পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির জন্য চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর শতক প্রতি ৫-৬ কেজি গোবর, ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, অধিক ভিজা বা পচা গোবর পুকুরে দেয়া যাবে না।

৩. ব্রুডমাছ মজুদ
সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হলে একর প্রতি ৭৫০-৯০০ কেজি বাছাই করা বিভিন্ন প্রজাতির ব্রুড উপযোগী মাছ (প্রাকৃতিক উৎসের বা পরিকল্পিতভাবে উৎপন্ন) মজুদ করতে হবে নিম্ন হারে।
ব্রুড মাছের পকুরে অধিক ঘনত্বে মাছ রাখলে ডিম আসে দেরিতে, ডিমের পরিপক্কতা লাভ করতে বিলম্বে হয় ও হ্যাচারির মালিক লাভ থেকে বঞ্চিত হন। মাছে নানা প্রকার রোগ বিশেষ করে আরগুলাস সমস্যা এবং অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিতে পারে। স্থানীয় চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ব্রুডমাছের প্রজাতি নির্বাচনে তারতম্য ঘটতে পারে। কাতল মাছের রেণুর চাহিদা বেশি থাকলে এবং দ্রুত ডিম আনতে পুকুরে কাতলের সাথে সিলভার কার্প মাছ না ছাড়াই ভালো। মৌসুমের শুরুতে রুই মাছে ডিম পাবার জন্য মজুদ ঘনত্ব কিছুটা কমাতে হবে এবং সে পুকুরে কাতল অথবা বিগহেড মাছ মজুদ না করা উত্তম।
মৃগেল মাছ
চিত্রঃ প্রাকৃতিক উৎসের মৃগেল মাছ

৪. সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ
প্রকৃতপক্ষে মা-মাছের পুষ্টির ওপর উৎপাদিত রেণুর জীবিত থাকা ও বর্ধনের হার অনেকাংশে নির্ভর করে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যের পাশাপাশি মাছের পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্যে আমিষের পরিমাণ ২৫-৩০% থাকা বাঞ্চনীয়। খাদ্যের উপকরণ নিম্নরূপ হতে পারেঃ
খাদ্য উপকরণসমূহ একত্রে মিশিয়ে বল বা পিলেট আকারে মাছের দৈহিক ওজনের ২-৩% হারে দৈনিক প্রয়োগ করতে হবে। অধিক শীতে এবং মেঘলা অবস্থায় খাদ্য কমিয়ে দিতে হবে। মাছ কতটুকু খাদ্য খাচ্ছে তা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ উচ্ছিষ্ট খাদ্য পচে পরিবেশ নষ্ট করলে পুকুরে ক্ষতিকর গ্যাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। পুকুরের গ্রাসকার্প মাছের জন্য ক্ষুদি পানা, নরম ঘাস বা কলাপাতা অবশ্যই দিতে হবে । গ্রাস কার্প মাছের ডিম আসা অনেকাংশে নির্ভর করে এ সকল খাদ্যের ওপর। খাদ্য তৈরিতে গরুর রক্ত ব্যবহার করলে খাদ্য পুষ্টিসমৃদ্ধ হয় এবং মাছের ডিম পুষ্ট হয় দ্রুত। ব্রুডমাছকে মাঝে মধ্যে খুদ সিদ্ধ করে খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।

৫. পানি ব্যবস্থাপনা
ব্রুড ব্যস্থাপনায় পুকুরের পানির গুণগতমান বিশেষ ভূমিকা রাখে। পুকুরের পরিবেশ ভালো রাখার জন্য পুকুরের পানি আংশিক পরির্বতন করতে হবে। বিশেষ করে খুব ভোরে ব্রুডমাছের পুকুরে মাঝে মধ্যে পানি সরবরাহ (water flash) করলে মাছ অক্সিজেনের স্বল্পতা হতে মুক্ত থাকায় ধকল থেকে মুক্ত থাকে। নতুন পানি পাওয়ায় মাছের শারীরবৃত্তিক কার্যক্রম বেড়ে যায়, ডিমের বিকাশ সঠিকভাবে হয় এবং দ্রুত পুষ্ট হয়।

৬. অন্যান্য পরিচর্যা
পুকুরের তলদেশে গ্যাস জমেছে কি না তা দেখতে হবে এবং মাঝে-মধ্যে হররা টেনে বা পুকুরের তলদেশ আলোড়িত করে গ্যাস অপসারণ করতে হবে। মাঝে মধ্যে মাছ ধরে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। মাছ অপুষ্ট মনে হলে খাদ্য প্রয়োগের হার বাড়াতে হবে। পুকুরের পরিবেশ ভালো রাখার জন্য অল্প মাত্রায় (শতকে ১০০ গ্রাম) চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্য পরীক্ষা বা পানির রং পর্যবেক্ষণ করে পূর্বে উল্লেখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ব্রুড মাছের পরিচর্যা করলে সাধারণত তেমন কোনো রোগ দেখা দেয় না। তবে অনেক সময় ব্রুড মাছে আরগুলাস এর সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। এতে রুই মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়। মাছে ডিম আসতে দেরী হয়, ডিম পুষ্ট হয় না ও রেণুর গুণগত মান খুব খারাপ হয় বিধায় রেণুর বাঁচার হার অনেক কমে যায়। এর ফলে হ্যাচারি মালিক বিশেষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কোনো ব্রুড মাছের পুকুরে আরগুলাস দেখা দিলে বুঝতে হবে ব্রুড ব্যবস্থাপনা সঠিক হচ্ছে না। অধিক জৈব পদার্থ পচন (খৈল অধিক পচিয়ে পুকুরে দেয়া, অধিক পচা গোবর পুকুরে প্রয়োগ, বাঁশ অথবা সবুজ পাতাসমৃদ্ধ গাছের ডাল পানিতে ভিজিয়ে রাখা) ও অধিক ঘনত্বে মাছ রাখা আরগুলাস সমস্যার প্রধান কারণ। এ সমস্যা হলে দ্রুত প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য পুকুরে ০.৩৫ পিপিএম হারেডিপটারেক্স বা সুমিথিয়ন দিতে হবে। আক্রান্ত পুকুরে প্রতি ৭ দিন অন্তর মোট তিন বার ডিপটারেক্স বা সুমিথিয়ন প্রয়োগ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, এ চিকিৎসা প্রয়োগে আরগুলাস দূর হয় কিন্তু পুকুরের সমস্ত প্রাণীকণা (zooplankton) মারা যায় বিধায় কাতল অথবা বিগহেড মাছের পুষ্টি সমস্যা দেখা দেয় এবং তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এজন্য পুকুরে যাতে আরগুলাস সমস্যা না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আরগুলাস (মাছের উকুন) সমস্যা ছাড়াও ব্রুডমাছের পুকুরে অক্সিজেন সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। মাছ সকাল ৮:০০-৯:০০ ঘটিকা পর্যন্ত পানির উপর স্তরে এসে খাবি খেতে থাকে এবং অনেক সময় ভোরে মাছ মরে ভেসে উঠতে পারে। সাধারণত ব্রুডমাছ অধিক ঘনত্বে রাখলে এ সমস্যা দেখা দেয়; তবে অধিক খাদ্য বা সার প্রয়োগের কারণেও এ সমস্যার সৃষ্টি হতে দেখা যায়। সমস্যা দেখা দেবার সাথে সাথে পুকরের পানি আলোড়িত করার ব্যবস্থা করতে হবে (সাঁতার কাটা, পাতিল অথবা বাঁশ দিয়ে পানির উপরে আঘাত করা)। বর্তমানে বাজারে পানিতে অক্সিজেন বৃদ্ধিকারক নানা ধরনের উপকরণ যেমন অক্সিফো, অক্সিগোল্ড, কুইক অক্সিজেন প্রভৃতি পাওয়া যায় যা প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে পানি প্রবাহের মাধ্যমে স্রোতের সৃষ্টি করলে এ সমস্যা দ্রুত দূর করা যায়। সকাল ৮:০০-৯:০০ ঘটিকা পর্যন্ত মাছ ভেসে থাকলে অনেকে এটাকে সমস্যা হিসেবে মনে করতে চান না কিন্তু এটা ঠিক নয়। কারণ মাছ অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যায় পড়লে অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়ে এবং মারাত্নক ধকলে পড়ে। এ অবস্থায় মাছের খাবার গ্রহণে অরুচি হয় ও স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়। এ ছাড়া বিশেষ করে গোনাড বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে মাছে ডিম আসতে বেশি সময় লাগে এবং ডিমের পুষ্টি সমস্যা থাকে। এ ধরনের ডিম থেকে উৎপাদিত রেণুর বৃদ্ধি ভালো হয় না। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে একজন সন্তান সম্ভাবা মায়ের যেমন আমরা যত্ন নিই তেমনি একটি মা মাছেরও (ব্রুডমাছ) সেরূপ যত্ন নিতে হবে।

উপসংহার
একটি হ্যাচারির সফলতা, বিশেষ করে হ্যাচারির কলাকুশলিদের মাছ প্রজননে সফলতা ব্রুডমাছের স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে। ব্রুডমাছ ভালো থাকলে মাছের প্রজনন এবং রেণুর পরিচর্যা পর্যায়ে কোনো প্রকার সমস্যা দেখা দেয় না এবং নার্সারি পুকুরে রেণুর বাঁচার হার সর্বোচ্চ হয়। এর ফলে রেণু চাষি লাভবান হন এবং হ্যাচারির সুনাম বৃদ্ধি পায় ও মালিক লাভবান হতে পারেন। এজন্য যারা কার্প হ্যাচারির সাথে যুক্ত আছেন তাদের সকলকে ব্রুডমাছ প্রতিপালনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। 




খাদ্য প্রয়োগের মাত্রাঃ
প্রতিদিন নূন্যতম তিন বেলা খাদ্য প্রদান করা উচিত। সূর্যোদয়, (সকাল ১০-১১ ঘটিকা) এবং সূর্যাস্তের সময়। চিংড়ি সেহেতু নিশাচর সেজন্য সন্ধ্যাবেলায় দিনের মোট খাদ্যের ৫০%, ভোরে ৩০% এবং দুপুর বেলা ২০% দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের খাদ্য তৈরি করলে ভাল হয়। অবশ্য যাদের বাড়িতে রেফ্রিজারেটর আছে তারা কয়েক দিনের খাবার একসঙ্গে তৈরি করতে পারেন। প্রতি ১০০০ পি,এল-এর জন্য প্রতিদিন নিম্ন মাত্রায় খাবার প্রদান করা যেতে পারে-

 

 

 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন